নামাজের ১৩ ফরজ কি কি

নামাজের ১৩ ফরজ কি কি আমাদের প্রতিটি মুসলমানের জন্য জানা ফরজ। নামাজের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে দোয়া, ক্ষমা প্রার্থনা বা রহমত ইত্যাদি। নামাজের আরবি শব্দ হচ্ছে সালাত। নামাজ, নামায অথবা সালাত আমরা যাই বলি এটি আমাদের ইসলাম ধর্মের একটি অন্যতম স্তম্ভ। 
নামাজ
নামাজ

নামাজ হচ্ছে মহান আল্লাহর নির্দেশ। ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ও দ্বিতীয় রুকন। যা প্রাপ্ত বয়স্ক, সুস্থ্য মস্তিষ্কসম্পন্ন মুসলিম পুরুষ ও মহিলার জন্য আদায় করা ফরজ করা হয়েছে। নামাজ বেহেস্তর চাবি। নামাজ আদায় কারিকে আল্লাহ অত্যন্ত সম্মানের সহিত বেহেশতে প্রবেশ করাবেন। 

মুসলমানদের জন্য নামাজ ফরজ করা হয়েছে তাই আমাদের নামাজ পড়তেই হবে কোন ধরণের অযুহাত ছাড়া। নামাজ হচ্ছে ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং ফজিলত পূর্ণ একটি অংশ। মুসলমান এবং কাফেরদের মধ্যে পার্থক্যই হল নামাজ। কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম নামাজেরই হিসাব নেওয়া হবে।

নামাজ হচ্ছে ফরজ ইবাদত। নামাজ ছাড়া জান্নাতে যাওয়া সম্ভব নয়। নামাজ দৈনিক নিয়মিত পালনীয় একটি ইবাদত। একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নামাজ আদায় করতে হয়। যা কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত রয়েছে। এটি মুসলমানদের জন্য প্রতিদিন অবশ্যকরণীয় একটি ধর্মীয় কাজ। 

তবে প্রতিদিন অবশ্যকরণীয় বা ফরজ ছাড়াও নানা প্রকার নামাজ রয়েছে। যা সময়ভিত্তিক বা বিষয়ভিত্তিক। যেহেতু সালাত একটি সুনির্দিষ্ট ইবাদত। যার পদ্ধতি ইসলামী শরিয়াতে পরিপূর্ণভাবে বর্ণিত হয়েছে। তাই নামাজ আদায় করতে হবে সহীহভাবে এবং ইসলামী নিয়মানুযায়ী। নামাজ সঠিক ভাবে আদায় করতে হলে অবশ্যই নামাজের ১৩টি ফরজ  জানতে হবে।

ফরজ কাকে বলে?

ফরজ একটি ইসলামী শব্দ যা অবশ্য কর্তব্য বা পালনীয় কোন ধর্মীয় আচারকে নির্দেশ করে। ফরজ ওই আদেশমূলক বিধানকে বলা হয় যা অকাট্যভাবে প্রমাণিত এবং তার অকাট্যতার ওপর নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস রাখা ও আমল করা অপরিহার্য করা হয়েছে। ইসলামে ফরজ কাজকে অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। 

ফরজ অবশ্যই আমাদের পালন করতে হবে। কোন ওজর ব্যতীত তা ত্যাগকারীকে ‘ফাসিক’ বলে গণ্য করা হয় এবং তার অস্বীকারকারী ‘কাফির’ বলে গণ্য হয়। (উসুলে সারখসি ১/১১০)।

ফরজ কত প্রকার ও কি কি?

ফরজ দুই প্রকারঃ
ফরজে আইন ও ফরজে কিফায়া। ফরজ ত্যাগকারী গুনাহগারে লিপিবদ্ধ হবে। এবং সে শাস্তির সম্মুখীন হবে।

নামাজের ১৩ ফরজ কি কি?

নামাজের বাহিরে রয়েছে মোট সাত ফরজ। আর নামাযের ভেতরে রয়েছে ছয় ফরজ। নামাজ পড়া শুরুর আগে অবশ্যই সাতটি ফরজ মানতে হয়। এবং নামাজ আদায়কালীন সময়ে ছয়টি ফরজ আদায় করতে হয়। এই ১৩ ফরজের একটি ফরজ যদি পালন করা না হয়। 

তবে নামাজ আদায় হবে না। নতুন করে আবারও পুনরায় নামাজ আদায় করতে হবে। যদি নতুন করেও আবারও নামাজ আদায় করা না হয়। তবে আমরা সাওয়াব থেকে বঞ্চিত হবো এবং গুনাহ এর ভাগীদার হবো। 

তাই নামাজ আদায় শুরুর আগে এবং নামাজ আদায়কালীন সময় আমাদের নামাজের ১৩ ফরজ কি কি তা অবশ্যই জানতে হবে এবং সঠিকভাবে মানতে হবে।

নামাজের বাহিরে ৭টি ফরজ সমূহ?

নামাজ আদায় আমাদের মুসলমানের জন্য অবশ্যই ফরজ কাজ। আর নামাজ অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন মেনে আদায় করতে হয়। নামাজের বাহিরের কাজগুলোকে আহকাম বলে। 

আহকাম ও আরকান মিলিয়ে নামাজের ফরজ মোট ১৩টি। নামাজের আহকাম ৭টি। নিচে প্রতিটির সংক্ষেপে আলাচনা করা হলঃ

১. নামাজের জায়গা পাক হওয়া

অর্থাৎ নামাজির দু’পা, দু’হাঁটু,দু’হাত ও সিজদার স্থান পাক হতে হবে। তা না হলে নামাজ হবে না। নাপাক স্থানে নামাজ পড়লে নামাজ হবে না। তাই যে জায়গায় নামাজ পড়তে হবে। সেই জায়গাটি অবশ্যই পাক বা পবিত্র হতে হবে।

২. শরীর পাক হওয়া

পবিত্রতা হচ্ছে ইমানের অঙ্গ। তাই নামাজে পাক হওয়া সবচেয়ে বেশি জরুরী। আল্লাহ নাপাক কিছু গ্রহন করেন না। এর জন্য অজুর দরকার হলে অজু বা তায়াম্মুম করতে হবে। গোসল ফরজ হলে গোসল করতে হবে। 

এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তালা বলেন, হে মুমিনগণ যখন তোমরা সালাতে দণ্ডায়মান হতে চাও তখন তোমাদের মুখ ও হাতের কনুই পর্যন্ত হাত ধৌত কর, মাথা মাসেহ কর এবং টাখনু পর্যন্ত পা ধৌত কর।  (সূরা মায়েদাঃ ৬)।

৩. কাপড় পাক হওয়া

নামাজের সময় অবশ্যই পরনের জামা, পায়জামা, লুঙ্গি, টুপি, শাড়ি ইত্যাদি পাক পবিত্র হওয়া প্রয়োজন। নাপাক কাপড়ে নামাজ হয় না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তালা বলেন, আর তোমার পোশাক-পরিচ্ছদ পবিত্র কর। (সূরা মুদ্দাসসিরঃ ৪)।

৪. সতর বা শরীর ঢাকা

সাধারণত সতর বলতে পুরুষের নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত এবং মহিলাদের দু’হাতের কব্জি,পদদ্বয় এবং মুখমন্ডল ব্যতীত সমস্ত দেহ ঢেকে রেখে নামাজে দাঁড়াতে হবে। সঠিকভাবে সতর না ঢাকলে নামাজ হবে না। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তালা বলেন, হে বনী আদম, তোমরা প্রতি সালাতে তোমাদের বেশ-ভূষা গ্রহণ কর। (সূরা আরাফঃ৩১)।

৫. কিবলামুখী হওয়া

মুসলমানদের বর্তমান কিবলা হল মক্কার কাবা ঘর। নামাজের সময় অবশ্যই কিবলা মূখী হয়ে দাঁড়াতে হবে। কিবলা মানে কাবার দিকে মুখ করে নামাজ পড়া। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, আর তুমি যেখান থেকেই বের হও, তোমার চেহারা মাসজিদুল হারামের দিকে ফিরাও এবং তোমরা যেখানেই থাক, তার দিকে তোমাদের চেহারা ফিরাও। (সূরা বাকারাঃ ১৫০)।

৬. ওয়াক্ত অনুযায়ী নামাজ পড়া

নামাজের সময় হওয়ার সাথে সাথে নামাজ আদায় করতে হবে। অর্থাৎ যখন থেকে নামাজের ওয়াক্ত শুরু হয় ঠিক সাথে সাথে নামাজ আদায় করে নেওয়া উচিত। প্রত্যেক ওয়াক্তের নামাজ অবশ্যই সময়মতো আদায় করতে হবে। আমরা অনেক সময় ইচ্ছা করে নামাজ ওয়াক্ত মত না পড়ে কাজ্বা করে ফেলি। 

এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সলাত মুমিনদের উপর নির্দিষ্ট সময়ে ফরয করা হয়েছে।  (সূরা নিসাঃ১০৩)।

৭. নামাজের নিয়্যাত করা

নিয়্যাত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আমাদের নিয়্যাতের উপরেই মূলত সবকিছ নির্ভর করে থাকে। নামাজ আদায়ের জন্য প্রথমেই সেই ওয়াক্তের নামাজের নিয়্যাত করা আবশ্যক। এ প্রসঙ্গে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, নিশ্চই আমলের গ্রহণযোগ্যতা নিয়্যাতের ওপর নির্ভরশীল।  (বুখারী,হাদিস-১)।

নামাযের ভিতরে ৬টি ফরজ সমূহ?

নামাজ মুসলমানের জন্য অবশ্য পালনীয় একটি ইবাদত। নামাজ আদায়কালীন সময়ে ছয়টি ফরজ কাজ রয়েছে যা অবশ্যই ধারাবাহিকভাবে আদায় করতে হবে। আর নামাজের ভিতরের কাজগুলোকে আরকান বলে। আরকান হচ্ছে ছয়টি। একটি ফরজ যদি ছুটে যায় তবে নামাজ হবে না। 

আবারও অবশ্যই নতুন করে নামাজ আদায় করতে হবে। নামাজ আদায় না করলে উক্ত নামাজের ক্বাযা আদায় করতে হবে। ক্বাযা আদায় করা না হলে গুনাহগার হতে হবে। তাই নিচে উল্লিখিত নামাজের ভিতরের ছয় ফরজ অবশ্যই পালন করতে হবে। যেমনঃ

১. তাকবীরে তাহরীমা

আল্লাহর মহত্ত্ব প্রকাশ পায় এমন শব্দ দ্বারা নামাজ আরম্ভ করা ফরজ কাজ। আর তা হচ্ছে তাকবিরে তাহরিমা তথা আল্লাহু আকবার বলা। যা দ্বারা নামাজের বাহিরের সব ধরণের কাজ নিষিদ্ধ হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন, তোমার প্রতিপালকের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর। 

অর্থাৎ মুখে আল্লাহু আকবার উচ্চারণ করতে হবে, এবং উভয় হাত কানের লতি পর্যন্ত তুলে নিয়ত বাঁধতে হবে তারপর নামাজের পরবর্তী কার্যক্রম শুরু করতে হবে। (সুরা মুদদাসসির : আয়াত ৩)।

২. দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করতে হবে

মুসলমানদের দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মনে রাখতে হবে কোন জরুরী ওজর ছাড়া বসে নামাজ আদায় করলে নামাজ হবে না। দাঁড়িয়ে নামাজ পড়া ফরজ। শারীরিকভাবে যদি অসুস্থ হন তাহলে বসে নামাজ আদায় করতে পারবেন। তবে সেটা অবশ্যই জরুরী ওজর হতে হবে। সামান্য কোন কারনেই বসে নামাজ পড়া যাবে না।

৩. কেরাত পাঠ করতে হবে

আপনি যদি ইমাম সাহেবের পিছনে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়েন তাহলে আর আলাদা করে কেরাত পাঠ করতে হবে না। যদি একাকী নামাজ আদায় করেন তাহলে আপনাকে অবশ্যই কেরাত পাঠ করতে হবে। তা যেন আবার শুদ্ধ হয়ে থাকে। কেরাত পাঠ শুদ্ধ না হলে নামাজ আদায় হবে না। তাই শুদ্ধ ও সঠিক উচ্চারনে কেরাত পাঠ করতে হবে।

৪. রুকু করা

রুকুতে সাধারণত বিজোড় সংখ্যকবার অর্থ্যাৎ ৩/৫/৭ সুবহানাল্লাহ রাব্বিয়াল আজিম পাঠ করতে হবে। এবং রুকু থেকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কমপক্ষে একবার সুবহানাল্লাহ বলতে যতটুকু সময় লাগে ততটুকু সময় অপেক্ষা করতে হবে। এগুলো ঠিকঠাক না করলে নামাজ হবে না।

৫. সিজদা করা

সেই একই নিয়মে সেজদাতে গিয়েও বিজোড় সংখ্যকবার ৩/৫/৭ সুবহানাল্লাহ রাব্বিয়াল আলা পাঠ করতে হবে। প্রথম সেজদা দেওয়ার পর দ্বিতীয় সেজদা দেওয়ার আগে কমপক্ষে একবার সুবহানাল্লাহ বলতে যতটুকু সময় লাগে ততটুকু সময় বসে থাকতে হবে। তা না হলে নামাজের ফরজ আদায় হবে না।

৬. আখেরি বৈঠকে বসতে হবে

নামাজের শেষে বসে আত্তাহিয়াতু,দরুদ শরীফ এবং দোয়ায়ে মাসুরা পাঠ করতে হবে। এটাকে আখেরি বৈঠক বলা হয়। এরপর সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করতে হবে। এগুলোকে নামাজের ফরজ বা আরকান বলা হয়।

বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ?

নামাজের ১৩ ফরজ কি কি এই বিষয়ে আপনাদের মনে বেশ কিছু পশ্ন থাকতে পারে। তবে চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই সমস্ত সকল প্রশ্ন এবং তার উত্তর।

নামাজের দ্বিতীয় কাতার শুরু কোথা থেকে?

সাধারণত ইমামের পিছনের দিক থেকে কাতার শুরু হতে হবে। এরপরের সারিটি হচ্ছে দ্বিতীয় কাতার। এবং প্রতিটি সারির ডান দিক বাম দিক অপেক্ষা ভাল। সামনের কাতার সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আরেকটি নতুন কাতার শুরু করা একদম উচিত নয়।

পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কত রাকাত ফরজ?

পাঁচ ওয়াক্ত নাাজের মধ্যে যথাক্রমে ফজরের দুই রাকাত নামাজ, যোহরের চার রাকাত নামাজ, আসরের চার রাকাত নামাজ, মাগরিবের তিন রাকাত নামাজ এবং এশার এর চার রাকাত নামাজ ফরজ নামাজ। এই হচ্ছে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে মোট ১৭ রাকাত ফরজ।

উপসংহার

নামাযে কোন কারণে ফরয ভুলে বাদ পড়ে গেলে আবার নতুন করে নামায আদায় করতে হবে। অর্থাৎ আপনি যদি ভুলবশত নামাজের কোন ফরজ আদায় করতে ভুলে যান। তাহলে আপনাকে আবারও নামাজ শুরু থেকে আদায় করতে হবে। 

নামাজের বাহিরের সাত ফরজ কিংবা নামাজের ভিতরের ছয় ফরজের থেকে যেকোন ফরজ ছুটে গেলে নতুন করে নামাজ আদায় করতে হবে। না হলে ক্বাযা নামাজ আদায় করতে হবে। ক্বাযা নামাজ আদায় করা না হলে গুনাহগার হতে হবে। 

তাই অবশ্যই নামাজের ১৩ ফরজের মাঝে কোন ফরজ ছুটে গেলে আবারও নামাজ আদায় করতেই হবে। কোন ফরজ যদি একের অধিকবার আদায় করা হয় তবে তা সাহু সিজদা দিলে শুদ্ধ হয়ে যাবে। সুন্নত বাদ পড়লে বা সুন্নত একাধিকবার পড়লে তখন আর সাহু সিজদা দিতে হবে না। ওয়াজিব এর ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য।

তবে মনে রাখবেন নামাজের কোন ওয়াজিব একাধিকবার পড়লে বা ছুটে গেলে সাহু সিজদা দিতে হবে। সাহু সিজদা দেয়ার জন্য শেষ বৈঠকে তাশাহুদ, দরুদ শরিফ, দোয়া মাসুরা পড়ার পর তাকবির দিয়ে পর পর দুইবার সিজদা করতে হবে। 

এরপর সালাম ফিরিয়ে নামাজ আদায় সম্পন্ন করতে হবে। তাই অবশ্যই আমাদের নামাজের ১৩ ফরজ কি কি জানতে হবে এবং মানতে হবে।
Next Post Previous Post