জানাজার নামাজের দোয়া | জানাজার নামাজের নিয়ম
জানাজার নামাজের নিয়ম আমাদের সবারই জানা উচিত। আমরা কেউ চিরজীবী নই, আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের সূরা আল ইমরানে বলেছেন 'প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে’।
![]() |
জানাযার নিয়ম |
তাই মুসলমান হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের উচিত জানাজার নামাজের নিয়ম জেনে সঠিক পদ্ধতিতে জানাযার নামাজ আদায় করা। আজকে যে শিশুটির জন্ম হলো তাকেও একদিন এই সুন্দর পৃথিবী ছাড়তে হবে, যেতে হবে অনন্তকালের পরপারে।
দুনিয়ার জীবনের এই নির্দিষ্ট সময় পৃথিবী মানুষের জন্য শুধুমাত্র এক পরীক্ষাই বটে। তাই চলুন আমরা জানাজার নামাজের নিয়মগুলো জেনে নেইঃ
- একজন ইমামের নেতৃত্বে জানাজার নামাজ জামা'আতের সঙ্গে বা দলবদ্ধভাবে পড়তে হয়।
- জানাজার নামাজে সাধারণত বেজোড় সংখ্যক কাতার বা সারিতে লাইন সোজা করে দাঁড়িয়ে এ নামায আদায় করা হয়। দুই কাতারের মাঝে সিজদাহ্ দেওয়ার মতো জায়গা ফাঁকা রাখতে হবে।
- চার তাকবীরের সহিত জানাযার নামাজ আদায় করতে হয় এবং সালাম ফেরানোর মধ্য দিয়ে এ নামায শেষ হয়।
- দুই ঈদের নামাজের সময় তাকবীর দেয়ার সময় উভয় হাত তুলতে হলেও জানাযার নামাজে তাকবীর দেয়ার সময় হাত তোলার কোনো প্রয়োজন নেই।
জানাযার নামাযের শেষে সাধারণত দোয়া বা মোনাজাত করতে হয় না কারণ ইসলামের প্রতিষ্ঠিত বিধান অনুযায়ী উক্ত নামাযের মাধ্যমেই মৃতের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা হয়।
জানাজার নামাজ শেষে মৃতব্যক্তিকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গোরস্থানে নিতে হবে এবং ইসলামী শরিয়া মোতাবেক তৈরিকৃত কবরে দাফন করতে হয়।
জানাজার নামাজের দোয়া?
জানাযার নামাজ ফরজে কিফায়া, জানাজার নামাজের দোয়ার বাংলা উচ্চারণ যেমনটা হবে "আল্লাহুম্মাগফিরলি হাইয়্যেনা ওয়া মাইয়্যিতিনা ওয়া শাহিদিনা ওয়া গায়িইবিনা ও ছাগীরিনা ও কাবীরিনা ওয়া যাকারিনা ও উনছানা।আল্লাহুম্মা মান আহইয়াইতাহু মিন্না ফাআহয়িহি আলাল ইসলামি ওয়া মান তাওয়াফ ফাইতাহু মিন্না ফাতাওয়াফ ফাহু আলাল ইমান বেরাহমাতিকা ইয়া আর হামার রাহীমিন।" মুসলিমের মরদেহ কবরের রাখার সময় একটি দোয়া রয়েছে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের শিক্ষার জন্য এবং মানুষকে করবে রাখার সময় উক্ত দোয়া পাঠের জন্য উম্মতদের উৎসাহিত করেছেন। দোয়াটির বাংলা উচ্চারণ হলো, বিসমিল্লাহ ওয়া আলা সুন্নাতি রাসুলিল্লাহ।
আরেকটি বর্ণনায় এসেছে- বিসমিল্লাহি ওয়া আলা মিল্লাতি রাসুলিল্লাহ। (তিরমিজি ও আবু দাউদ)।
জানাজার নামাজের দোয়া আরবিতে?
আরবিতে জানাজার নামাজের দোয়াঃ"اللَّهُمَّ اغْفِرْلحَيِّنَاوَمَيِّتِنَا وَشَاهِدِنَا وَغَائِبِنَا وَصَغِيْرِنَا وَكَبِيْرِنَا وَذَكَرِنَا وَاُنْثَا نَا اَللَّهُمَّ مَنْ اَحْيَيْتَهُ مِنَّا فَاَحْيِهِ عَلَى الاِسْلاَمِ وَمَنْ تَوَفَّيْتَهُ مِنَّا فَتَوَفَّهُ عَلَى الاْيمَانِ بِرَحْمَتِكَ يَا ارْحَمَ الرَّاحِمِيْنَ"
তবে অপ্রাপ্তবয়স্ক বা নাবালক ছেলের ক্ষেত্রে জানাযার দোয়া এরূপ পড়তে হবেঃ
اَللَّهُمَّ اجْعَلْهُ لَنَا فَرْطًا وْاَجْعَلْهُ لَنَا اَجْرًا وَذُخْرًا وَاجْعَلْهُ لَنَا شَافِعًا "وَمُشَفَّعًا
অন্যদিকে অপ্রাপ্তবয়স্ক বা নাবালিকা মেয়ের জন্য পড়তে হবেঃ
"اللَّهُمَّ اجْعَلْهَا لَنَا فَرْطًا وَاجْعَلْهَا لَنَا اَجْرًا وَذُخْرًاوَاجْعَلْهَا لَنَا شَافِعَةً وَمُشَفَّعَة"
জানাজার নামাজের নিয়ত?
জানাজার নামাজে মহান আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা ও রাসূল (সাঃ) এর ওপর দরুদ পাঠ করা হয়। আপনি চাইলে বাংলায় নিয়ত করতে পারবেন, নিয়ত বাংলায় বলে অথবা মনে মনে নিয়তে করলেও চলবে। নিয়তে তাকবীরে তাহরিমা অর্থাৎ, 'আল্লাহু আকবার' বলার পর হাত তুলে তারপর অন্যান্য নামাজের ন্যায় দুই হাত বেঁধে নিতে হবে, হাত বাধা শেষ হলে সানা পড়তে হবে।জানাজার নামাজের নিয়তের বাংলা উচ্চারণ, "নাওয়াইতু আন উয়াদ্দিয়া লিল্লাহে তায়ালা আরবা আ তাকবীরাতে ছালাতিল জানাজাতে ফারজুল কেফায়াতে আচ্ছানাউ লিল্লাহি তায়ালা ওয়াচ্ছালাতু আলান্নাবীয়্যে ওয়াদ্দোয়াউ লেহাযাল মাইয়্যেতে এক্কতেদায়িতু বিহাযাল ইমাম মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারিফাতে আললাহু আকবার।"
যেকোনো নামাজের নিয়তই আরবিতে করতে না পারলে নিজের ভাষাতে করলেও চলবে যেমন, ‘আমি চার তাকবিরের সহিত ফরজে কিফায়া জানাযার নামাজ কিবলামুখী হয়ে ইমামের পিছনে দাঁড়িয়ে মরহুম ব্যক্তির (পুরুষ/মহিলার) জন্য দোয়া করার উদ্দেশ্যে আদায় করছি। আল্লাহু আকবার।’
জানাজার নামাজের তৃতীয় দোয়া?
জানাজার নামাজে প্রথম তাকবির শেষে ছানা, দ্বিতীয় তাকবিরের পর দরূদে ইবরাহিম পড়তে হয়। এরপর মৃত ব্যক্তি যদি বালেগ বা প্রাপ্তবয়স্ক হয় তবে তার জন্য তৃতীয় তাকবিরের পর ইখলাসের সাথে হাদিসে বর্ণিত নিম্নের দোয়াটি পড়তে হবে,বাংলা উচ্চারণঃ
"আল্লাহুম্মাগফির লিহাইয়িনা ওয়া মাইয়িতিনা ওয়া শাহিদিনা ওয়া গায়িবিনা ওয়া সগিরিনা ওয়া কাবিরিনা ওয়া জাকিরিনা ওয়া উনছানা। আল্লাহুম্মা মান আহইয়াইতাহু মিন্না ফাআহয়িহি আ’লাল ইসলাম। ওয়া মান তাওয়াফফাইতাহু মিন্না ফাতাওয়াফফাহু আ’লাল ঈমান। আল্লাহুম্মা লা তাহরিমনা আযরাহ ওয়া'লা তুদিল্লানা বাআ’দা।"প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ (মুসনাদে আহমাদ, তিরমিজি, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, মিশকাত) এ দোয়াটি এসেছে। দোয়ার বাংলা অর্থ করলে দাড়ায়, হে আল্লাহ! আমাদের মধ্যে জীবিত, আমাদের মৃত, আমাদের মধ্যে উপস্থিত ও অনুপস্থিত, আমাদের ছোট ও বড়, আমাদের পুরুষ ও নারী সবার গুণাহ মাফ করে দিন।
হে আল্লাহ! আপনি যাদের বাচিয়ে রেখেছেন তাদেরকে ইসলামের উপর জীবিত রাখুন। আপনি যাদের মৃত্যু দেন, তাদের ঈমানের সাথে মৃত্যু দান করুন। হে আল্লাহ আমাদেরকে তার সওয়াব থেকে বঞ্চিত করবেন না এবং তার মৃত্যুর পর আমাদেরকে গোমরাহ বা বিপদের দিকে ফেলবেন না।
জানাজার নামাজের ইমামতির নিয়ম?
বুখারী শরীফের হাদিস এসেছে, "সবাই আল্লাহর ইবাদত হিসেবে জানাজার ফরজ আদায়ের নিয়ত করবে।" কুরআন- সুন্নাহ মোতাবেক জানাজার নামাজের ইমামতির নিয়ম গুলো হলোঃ১. জানাজার নামাজে ইমাম মৃতের বক্ষ বরাবর দাঁড়াবে।
২. ইমামের পেছনে মুক্তাদিদের কাতার হবে।
৩. প্রথম তাকবির শেষে ছানা পড়া।
তবে মনে রাখবেন, জানাজার নামাজের ছানা সাধারণ নামাজের ছানার চেয়ে কিঞ্চিত আলাদা, বাংলা উচ্চারণঃ "সুবহানাকাল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা, ওয়া তাবারকাসমুকা, ওয়া তাআলা জাদ্দুকা, ওয়া জাল্লা ছানা-উকাও ওয়া লা-ইলাহা গায়রুক।"
৪. নামাজে আমরা যে দরুদে ইব্রাহিম পড়ি দ্বিতীয় তাকবিরের পর সেই দরুদ পড়া।
৫. তৃতীয় তাকবির শেষ হলে দোয়া পড়া। মৃত ব্যক্তি প্রাপ্তবয়স্ক নাকি অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং নারী বা পুরুষ সে অনুযায়ী দোয়া পড়তে হবে।
৬. দোয়া শেষে চতুর্থ তাকবিরের পর সালাম ফিরিয়ে জানাজার নামাজ শেষ করা।
জানাজার নামাজের ফজিলত?
ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের নিয়তে মাইয়্যাতের জানাজা পড়া এবং দাফন পর্যন্ত কবরস্থানে অপেক্ষা করা সুন্নাত।প্রসিদ্ধ হাদিস গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী রাসূল সাল্লাল্লাহু সাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কোনো মৃত ব্যক্তির জানাজার নামাজ আদায় করে সে এক ‘কীরাত’ পরিমাণ নেকি অর্জন করে।আর যে ব্যক্তি কোনো মৃত মানুষের জানাজার নামাজ আদায় করে এবং তারপর দাফনের কাজে অংশগ্রহণ করে, সে দুই ‘কীরাত’ পরিমাণ সওয়াব লাভ করে।” ঐ সময় কোনো এক সাহাবি প্রশ্ন করে উঠলো, ‘হে আল্লাহর রাসুল! দুই কীরাত কী?’ মুহাম্মদ (সা.) বললেন, ‘দুই কিরাতের ক্ষুদ্রতম কীরাত হলো উহুদ পাহাড়ের সমান।’(ইবনে কাছির)।
স্বপ্নে জানাজার নামাজ দেখলে কি হয়?
স্বপ্নে জানাযার নামাজ পড়তে দেখলে কি হয় সেই ব্যাখ্যা নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে আছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। স্বপ্নে জানাযার নামাজ পড়তে দেখলে দুটি বিষয় ঘটতে পারে। প্রথমত, স্বপ্নের মধ্যে কেউ যদি নিজেকে ইমামের পেছনে জানাজার নামাজ পড়তে দেখেন তাহলে যিনি স্বপ্নে দেখবেন তিনি খুব দ্রুতই পাপ কাজ থেকে সত্য ও ন্যায়ের পথে ফিরে আসবেন বলে ধরে নেওয়া হয়।অর্থাৎ ইমামের পেছনে থেকে নিজের আত্মীয়-স্বজনের জানাজার নামাজে কিংবা অন্য কারো জন্য দোয়া করতে দেখলে তা হলো পাপ থেকে পূণ্যর পথে ফিরে আসার লক্ষণ।
দ্বিতীয়ত, কেউ যদি স্বপ্নে দেখে যে সে নিজেই ইমাম হিসেবে জানাজার নামাজ পড়ানোর জন্য সামনে এসেছেন কিংবা নিজে ইমাম হয়ে জানাজার নামাজ পড়াচ্ছেন তাহলে বুঝতে হবে তিনি খুব শীঘ্রই কোনো মুনাফিক বাদশাহর কাছ থেকে শাসন ক্ষমতা লাভ করবেন বলে ধারণা করা হয়। তবে সব ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন।
জানাজার নামাজের আরবি নিয়ত?
نَوَيْتُ اَنْ اُؤَدِّىَ لِلَّهِ تَعَا لَى اَرْبَعَ تَكْبِيْرَاتِ صَلَوةِ الْجَنَا زَةِ فَرْضَ الْكِفَايَةِ وَالثَّنَا ءُ لِلَّهِ تَعَا لَى وَالصَّلَوةُ عَلَى النَّبِىِّ وَالدُّعَا ءُلِهَذَا الْمَيِّتِ اِقْتِدَتُ بِهَذَا الاِْمَامِ مُتَوَجِّهًا اِلَى جِهَةِ الْكَعْبَةِ الشَّرِ يْفَةِ اَللَّهُ اَكْبَرُনিয়তের বাংলা উচ্চারণ উপরে দেওয় আছে। এখানে নিয়তে ‘লেহাযাল মাইয়্যেতে’ পুরুষ বা ছেলে মৃতব্যাক্তি হলে পড়তে হবে, আর লাশ নারী কিংবা মেয়ে হলে ‘লেহাযিহিল মাইয়্যেতে’ বলতে হবে।
জানাজার নামাজ কত বার পড়া যায়?
অনেকেই প্রশ্ন করে থাকেন একজন মৃত ব্যক্তির জানাজা কতবার পড়া যায় বা একাধিকবার জানাজা পড়া ইসলামসম্মত কিনা? এর উত্তর হলো, মৃত ব্যক্তির জানাজার ক্ষেত্রে রাসূল (সা.)-এর হাদিসের মাধ্যমে যেটা সাব্যস্ত হয়েছে তা হলো, জানাজা একবারই হবে।তবে বিশেষ কারণ অথবা প্রেক্ষাপট বিবেচনায় যদি কারো জানাজা দ্বিতীয়বার করার দরকার হয়, তাহলে সেটিও জায়েজ।
শেষকথা, জানাজা মূলত একবারই হবে। জানাজা দুই বা তিনবার করার দরকার নেই। কিন্তু যদি এমনটা হয় যে, একজন বিদেশে মারা যাওয়াতে বিদেশের লোকেরা তাঁর জানাজায় অংশগ্রহণ করতে চায় কেননা তাদের পক্ষে তার দেশে যাওয়া সম্ভব না।
আবার দেশে গেলে সেখানকার লোকেরা আবার জানাজা পড়তে চায় তাই সেটা বিশেষ কারণে হয়তোবা হতে পারে। তবে একবার হওয়াটাই হচ্ছে রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহ এবং ইহাই মূলত আজকের এই যুগ পর্যন্ত সালফেস সালেহিনের আমল দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে।
তবে কোনো সময় যদি এরকম বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হয় যেখানে একাধিকবার কেউ জানাজা পড়ে থাকে, তাহলে কোনো গুনাহ নেই। তবে সেটা উত্তম বা সুন্নাহ নয়।