আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকারের গুরুত্ব | সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ

সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ এর আরবি পরিভাষা হল আমর বিল মারূফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার৷ ইসলামি জীবনদর্শনে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এটি মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য৷ সৎকাজের আদেশ বা আমর বিল মারূফ বলতে সাধারণত কাউকে কোনরূপ ন্যায় ও ভালো কাজের নির্দেশ দান করা বোঝায়৷

 ব্যাপকার্থে কোন ব্যক্তিকে ইসলামসম্মত কাজের নির্দেশ দেওয়া উৎসাহিত করা অনুপ্রাণিত করা অনুরোধ করা পরামর্শ দেওয়া ইত্যাদি সবই সৎকাজের আদেশের মধ্যে গণ্য৷ অসৎকাজে নিষেধ বা নাহি আনিল মুনকার হল যাবতীয় মন্দ খারাপ ও অশ্লীল কাজ থেকে কাউকে বিরত রাখা৷ 

যেসব কাজ ইসলাম সমর্থন করে না এবং যেসব কাজ নীতি নৈতিকতা ও বুদ্ধি বিবেকবিরোধী সেসব কাজ থেকে কাউকে নিষেধ করা বিরত রাখা নিরুৎসাহিত করা বাধা দেওয়া ইত্যাদি নাহি আনিল মুনকার এর অন্তর্ভুক্ত৷ শুধু মৌখিক নিষেধের দ্বারা নয় বরং নানাভাবেই অসৎকাজ থেকে বিরত রাখা যায়৷
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ

একটি হাদিসে রাসুল (স.) বলছেন তোমাদের কেউ যখন কোন খারাপ কাজ হতে দেখে তবে সে যেন তা হাত দ্বারা প্রতিরোধ করে৷ যদি তা সম্ভব না হয় তবে মুখের দ্বারা প্রতিরোধ করে৷ যদি সে এ ক্ষমতাও না রাখে তবে সে যেন অন্তর দ্বারা এর প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে৷ আর এটা হল ইমানের দুর্বলতম স্তর৷ (মুসলিম)

এ হাদিসে মহানবি (স.) হাদ মুখ ও অন্তর দ্বারা নাহি আনিল মুনকার বা খারাপ কাজ প্রতিরোধ করার কথা বলেছেন। হাদিস বিশারদগণের মতে হাত দ্বারা বলতে এখানে নিজ শক্তি ক্ষমতা ও প্রভাব দ্বারা প্রতিরোধ করার কথা বোঝায়৷ মুখ দ্বারা প্রতিরোধ হল নিষেধ করা নিরুৎসাহিত করা জনমত গঠন করে প্রতিরোধ করা। 

আর অন্তর দ্বারা প্রতিরোধ হল মনে মনে ঐ কাজকে ঘৃণা করা ঐ কাজ বন্ধ হওয়ার জন্য আন্তরিকভাবে দোয়া করা প্রতিরোধের জন্য চিন্তা করা পরিকল্পনা করা এবং পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত অন্তরে উদ্বেগ উৎকন্ঠা থাকা ইত্যাদি৷ নানাভাবে মানুষকে অসৎকাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করাই নাহি আনিল মুনকার৷

সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা?

ইসলামে আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ৷ ইসলামি সমাজ ব্যবস্থা এর উপরই প্রতিষ্ঠিত৷ সমাজে সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎকাজে নিষেধ করার জন্য সবসময়ই কিছুসংখ্যক লোক থাকতে হয়৷ 

অন্যথায় সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় থাকে না৷ সমাজে অন্যায় অত্যাচার সন্ত্রাস নির্যাতন ছড়িয়ে পড়ে। সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ বিনষ্ট হয়ে যায়। সুষ্ঠু ও সুন্দর সমাজ ব্যবস্থার জন্য এরূপ লোকদের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎকাজে নিষেধ করা অত্যন্ত মহৎ কাজ৷ এ মহৎ কাজ যারা সম্পাদন করবেন আল্লাহ তায়ালা তাদের দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা দান করবেন৷ পবিত্র কুরআনে সৎকাজের আদেশদানকারী এবং অসৎকাজের নিষেধকারীকে মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম বলা হয়েছে৷ মহান আল্লাহ বলেনঃ
كُنْتُمْ خَيْرَ اُمَّةٍ اُخْرِ جَتْ لِلنَّاسِ تَاْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُوْنَ بِااللّٰهِ  ٹ

অর্থঃ তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি৷ মানবজাতির (কল্যাণের) জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দিবে এবং অসৎকাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে৷ (সূরা আলে ইমরান আয়াত ১১০)।

আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকার মুমিনগণের বৈশিষ্ট্য৷ এ কাজ ব্যতীত কোন ব্যক্তিই পূর্ণাঙ্গ মুমিন হতে পারবে না৷ আল্লাহ তায়ালা মুমিনগণের পরিচয় দিয়ে বললেনঃ
اَلَّذِيْنَ اِنْ مَّکَّنّٰهُمْ فِى الْاَرْضِ اَقَامُوْا الصَّلٰوةَ وَاٰتَوُا الزَّكٰوةَ وَاَمَرُوْا بِالْمَعْرُوْفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ ٹ  وَلِلّٰهِ عَاقِبَةُ الْاُمُوْرِ ٥

অর্থঃ আর তারা এমন লোক আমি তাদের পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে তারা নামায কায়েম করবে যাকাত প্রদান করবে সৎকাজের আদেশ দেবে ও অৎকাকে নিষেধ করবে৷ আর কর্মের প্রতিফলতো আল্লাহরই নিকট। (সূরা আল হাজ্জ আয়াত ৪১)।

সৎকাজের আদেশ সমাজে সৎ ও ন্যায় কার্যাবলির প্রসার ঘটায়৷ এর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সদাচরণ ও নৈতিক গুণাবলি বিকশিত হয়৷ আর অসৎ কাজের নিষেধ সমাজ থেকে অন্যায় অশ্লীলতা ও নির্যাতনের মূলোৎপাটন করে৷ মানুষ এর মাধ্যমে ন্যায় অন্যায় ভালো মন্দ বুঝতে শিখে ও ধীরে ধীরে সত্য ও ন্যায়ের পথ অনুসরণ করে৷

অন্যদিকে সমাজে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ না থাকলে সমাজ ধ্বংসের দ্বারাপ্রান্তে উপনীত হয়৷ একটি হাদিসে মহানবি (স.) একটি উপমার মাধ্যমে এ বিষয়টি তুলে ধরেছেন৷ তিনি বলেন আল্লাহর নির্ধারিত সীমার মধ্যে অবস্থানকারী ও সীমালংঘনকারীদের উদাহরণ হল একদল লোকের ন্যায় যারা জাহাজের যাত্রী৷

লটারির মাধ্যমে এদের একদল উপর তলায় ও অপর দল নিচতলায় স্থান পেল৷ নিচতলার লোকজন পানির প্রয়োজন হলে উপর তলার লোকদের নিকট পানি আনতে যায়৷ এমতাবস্থায় তারা (নিচতলার লোকজন) বলল আমরা যদি নিচেই একটা ছিদ্র করে নেই তবে উপর তলার লোকদের কষ্ট দেওয়া থেকে বাঁচা যেত৷ 

এখন যদি তারা (উপর তলার লোকজন) তাদের বাধা দেয় তবে নিজেরাও বাঁচতে পারে এবং সবাইকে বাঁচাতে পারবে৷ (বুখারি)। সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ মানুষকে ধ্বংস থেকে বিরত রাখে৷ এতে সমাজে দীন প্রতিষ্ঠিত হয়৷ আর যে ব্যক্তি এ কাজ করে সে আরও গভীরভাবে সৎকাজে উৎসাহী হয়৷ নিজ জীবনে সে ব্যক্তি সকল অন্যায় ও অসুন্দর কাজ থেকে বেঁচে থাকতে পারে৷

আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকার ত্যাগের পরিণতি?

সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা আবশ্যকীয় কর্তব্য৷ এ কর্তব্যে অবহেলা করার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ শাস্তি৷ আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ায়তেই এ জন্য শাস্তি প্রদান করেন৷ আর পরকালে এরূপ ব্যক্তিদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব৷ আল্লাহ তায়ালা বলেন বনব ইসরাইলের মধ্যে যারা কুফরি করেছে তাদেরকে দাউদ (আ.) ও ঈসা ইবনে মারাইয়ামের মুখ দিয়ে অভিশাপ দেওয়া হয়েছে৷ 

কেননা তারা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল ও অত্যন্ত বাড়াবাড়ি করেছিল৷ তারা পরস্পরকে মন্দকাজ থেকে বিরত রাখত না৷ বস্তুত অত্যন্ত জঘন্য কর্মনীতিই তারা অবলম্বন করছিল৷ (সূরা আল মায়িদা আয়াত ৭৮-৭৯)

মহানবি (স.) বলেছেন লোকেরা যখন কোন অত্যাচারীকে (অত্যাচার করতে) দেখে কিন্তু তারা তার হাত ধরে না (প্রতিরোধ করে না)  এরূপ লোকদের উপর অচিরেই আল্লাহ শাস্তি পাঠাবেন৷ (তিরমিযি)।

অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ৷ তোমরা অবশ্যই সৎকাজের আদেশ দেবে ও অসৎকাজে নিষেধ করবে৷ অন্যথায় অচিরেই আল্লাহ তোমাদের শাস্তি দেবেন৷ তখন তোমরা দোয়া করবে কিন্তু তা কবুল করা হবে না৷ (তিরমিযি)।

প্রকৃতপক্ষে আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকার মানব জীবনের অপরিহার্য কাজ৷ দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা এর উপরই নির্ভরশীল৷ তবে অন্যকে সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎকাজে নিষেধ করে বসে থাকলে চলবে না। বরং নিজেও তদনুযায়ী আমল করতে হবে৷ 

কেননা নিজে আমল না করে অন্যকে আদেশ দিলে পরকালে ভীষণ শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। মহানবি (স.) বলেছেন কিয়ামতের দিন এক ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হবে৷ অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এতে তার নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে আসবে৷ সে এটা নিয়ে চারপাশে চক্কর দিতে থাকবে যেমনভাবে গাধা চক্রের মধ্যে ঘুরে থাকে।

তখন জাহান্নামিরা তার চারপাশে সমবেত হবে এবং জিজ্ঞাসা করবে হে অমুক তোমরা এ অবস্থা কেন? তুমি কি সৎকাজের আদেশ দিতে না এবং অসৎকাজে নিষেধ করতে না? উত্তরে সে বলবে হ্যাঁ আমি সৎকাজের আদেশ দিতাম কিন্তু নিজে তা করতাম না। আর অন্যদের খারাপ কাজ থেকে নিষেধ করতাম কিন্তু নিজে তা থেকে বিরত থাকতাম না৷ (বুখারি ও মুসলিম)।

অতএব আমরা নিজেরা সৎকাজ করব ও অসৎকাজ থেকে বিরত থাকব৷ অতঃপর নিজ পরিবার পরিজন বন্ধু বান্ধব সহপাঠী প্রতিবেশী সকলকে সৎকাজে উৎসাহিত করব৷ সৎকাজে সাহায্য সহযোগিতা করব৷ আর অসৎকাজ থেকে তাদের বিরত রাখতে চেষ্টা করব৷ 

আমাদের সমাজে প্রচলিত অন্যায় অসত্য ও অশ্লীলতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলব। সকলে মিলে সকল অন্যায় ও অত্যাচার দূর করে সুন্দর ও শান্তিময় সমাজ গঠনে সচেষ্ট হব।
Next Post Previous Post