সুদ ও ঘুষ কি | সুদ সম্পর্কে ইসলামের বিধান pdf
সুদ কি?
সুদ ফার্সি শব্দ৷ এর আরবি প্রতিশব্দ রিবা (اَلرِّبٰوا) কাউকে প্রদত্ত ঋণের মূল পরিমাণের উপর অতিরিক্ত আদায় করাকে রিবা (اَلرِّبٰوا) বা সুদ বলা হয়৷ মহানবি (স.) এর আবির্ভাবকালে এটি একধরনের ব্যবসায়ে রূপান্তরিত হয়েছিল৷ আরবসহ বিশ্বের অনেক সমাজে এ প্রথা প্রচলিত ছিল৷![]() |
সুদ ও ঘুষ |
যার ফলে ধনী আরও ধনী হতো আর গরিব ক্রমান্বয়ে নিঃস্ব হয়ে যেত৷ এটা ছিল শোষণের নামান্তর৷ তাই ইসলাম এটাকে হারাম ঘোষণা করে৷ অনেকে সুদ ও মুনাফা বা লভ্যাংশকে সমরূপ মনে করেন৷ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এদুটো এক নয়৷
কেননা সুদে লোকসানের কোন ঝুঁকি থাকে না৷ আর মুনাফা বা লভ্যাংশে ঝুঁকি থাকে৷ সুদের সংজ্ঞা দিয়ে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেনঃ
كُلُّ قَرْضٍ جَرَّنَفْعًا فَهُوَرِبٰوا
كُلُّ قَرْضٍ جَرَّنَفْعًا فَهُوَرِبٰوا
অর্থঃ যে ঋণ কোন লাভ নিয়ে আসে তা ই রিবা (সুদ)। (জামি সগির)।
ঋণদাতা কর্তৃক ঋণগ্রহীতা থেকে মূলধনের অতিরিক্ত কোন লাভ নেওয়াই হল সুদ৷ যেমন কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে একশত টাকা এ শর্তে ঋণ দিল যে গ্রহীতা একশত দশ টাকা পরিশোধ করবে৷
এক্ষেত্রে একশত টাকার অতিরিক্ত দশ টাকা হল সুদ৷ কেননা এর কোন বিনিময় মূল্য নেই৷ শুধু টাকা পয়সা বা মাল সম্পদ বিনিময়েই সুদ সীমাবদ্ধ নয়৷ বরং একই শ্রেণিভূক্ত পণ্যদ্রব্যের লেনদেনে কম বেশি করা হলেও তা সুদের আওতাভুক্ত হবে৷ যেমন এক কেজি চালের বিনিময়ে দেড় কেজি চাল নেওয়া কিংবা এক কেজি চাল ও অতিরিক্ত অন্য কিছু নেওয়াও সুদ হবে৷
মহানবি (স.) স্পষ্ট করে বলেছেন সোনার বিনিময়ে সোনা রুপার বিনিময়ে রুপা যবের বিনিময়ে যব আটার বিনিময়ে আটা খেজুরের বিনিময়ে খেজুর লবণের বিনিময়ে লবণ এমনিভাবে সমজাতীয় দ্রব্যের নগদ আদান প্রদানে অতিরিক্ত কিছু হলেই তা সুদ হবে৷ (মুসলিম)।
ঘুষ কি?
ঘুষ অর্থ উৎকোচ৷ স্বাভাবিক প্রাপ্যের পরও অসদুপায়ে অতিরিক্ত সম্পদ বা সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করাকে ঘুষ বলে৷ কোন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারী তাদের কাজের জন্য নির্দিষ্ট বেতন ভাতা পায় কিন্তু তারা যদি ঐ কাজের জন্যই অন্যায়ভাবে আরও বেশি কিছু গ্রহণ করে তা হল ঘুষ৷যেমন কারও কোন কাজ আটকে রেখে তার নিকট থেকে টাকা পয়সা আদায় করা অন্য কথায় অধিকার নেই এরূপ বস্তু বা বিষয় লাভের জন্য দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষকে অন্যায়ভাবে কোস সম্পদ বা সুযোগ সুবিধা দেওয়া কিংবা নেওয়াকে ঘুষ বলা হয়৷
সমাজে নানাভাবে ঘুষের প্রচলন দেখা যায়৷ সাধারণত মানুষ অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য টাকা পয়সা ঘুষ দিয়ে থাকে৷ এ ছাড়া উপহারের নামে নানা দ্রব্যসামগ্রী যেমন টিভি ফ্রিজ গহনা ফ্ল্যাট ইত্যাদিও ঘুষ হিসেবে দেওয়া হয়৷ বস্তুত দ্রব্যসামগ্রী যে মূল্যমানেরই হোক টাকা পয়সা কম হোক বা বেশি হোক ঘুষ হিসেবে ব্যবহৃত হলে তা হারাম হবে৷
সুদ ও ঘুষের কুফল ও পরিণতি কি কি?
সুদ ও ঘুষ অত্যন্ত জঘন্য অর্থনৈতিক অপরাধ৷ এর কুফল ও অপকারিতা অত্যন্ত ভয়াবহ৷ সুদ মানবসমাজে অর্থনৈতিত বৈষম্যের জন্ম দেয়৷ ধনী আরও ধনী হয়৷ গরিব আরও গরিব হয়৷ ফলে সমাজের মধ্যে শ্রেণিভেদ গড়ে ওঠে৷ পারস্পরিক মায়া মমতা ভালোবাসা ও সহযোগিতার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়৷ সিদের কারণে জাতীয় প্রবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নতি ব্যাহত হয়৷লোকেরা বিনিয়োগে উৎসাহী হয় না৷ বরং সম্পদ অনুৎপাদনশীলভাবে সুদি কারবারে লাগায়৷ ফলে দেশের বিনিয়োগ কমে যায় জাতীয় উন্নতি বাধাগ্রস্ত হয়৷ ঘুষও মানবসমাজে অশান্তি ডেকে আনে৷ ঘুষখোর ব্যক্তি নিজ দায়িত্ব কর্তব্যে অবহেলা করে আমানতের খিয়ানত করে৷
নিজ ক্ষমতা ও দায়িত্বের অপব্যবহার করে৷ ঘুষদাতা ও ঘুষখোর অন্য লোকের অধিকার হরণ করে৷ ফলে অধিকার বঞ্চিতদের সাথে তাদের শক্রতা সৃষ্টি হয়৷ সমাজে মারামারি হানাহানির সূত্রপাত ঘটে৷ বস্তুত সুদ ও ঘুষের অপকারিতা অত্যন্ত মারাত্মক৷
এটি সমাজে নৈতিক অবক্ষয় ডেকে আনে৷ সুদ ও ঘুষের প্রভাবে মানুষ নৈতিক ও মানবিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে৷ বরং অসৎ চরিত্র ও মন্দ অভ্যাসের চর্চা শুরু করে৷ মানুষের মধ্যে লোভ লালসা অপচয় ও পাপাচারের প্রসার ঘটে৷ অনেক সময় সুদ ঘুষের অতিরিক্ত অর্থের জন্য মানুষ নানা রূপ অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে৷ সন্ত্রাস ছিনতাই রাহাজানি খুন ইত্যাদি বৃদ্ধি পায়৷
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন যে সমাজে জিনা ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়ে তার অধিবাসীরা দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে নিপতিত হয়৷ আর যে সমাজে ঘুষ লেনদেন প্রসার লাভ করে সে সমাজে ভীতি ও সন্ত্রাস সৃষ্টি হয়ে থাকে৷ (মুসনাদে আহমাদ)।
আর্থসামাজিক দিক দিয়ে সুদ ও ঘুষের প্রভাব অত্যন্ত ক্ষতিকর৷ ধর্মীয় দিক থেকেও এর কুফল অত্যন্ত ব্যাপক৷ সুদ ঘুষের মাধ্যমে উপার্জিত সম্পদ হারাম বা অবৈধ৷ আর হারাম কোন অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়৷ যার শরীর হারাম খাদ্যে গঠিত যার পোশাক পরিচ্ছদ হারাম টাকায় অর্জিত এরূপ ব্যক্তির কোন ইবাদত কবুল হয় না এমনকি তার কোন দোয়াও আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন না৷
সুদ ও ঘুষের লেনদেনকারী যেমন মানুষের নিকট ঘৃণিত তেমনি সে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (স.) এর নিকটও ঘৃণিত৷ আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (স.) সুদ ও ঘুষের লেনদেনকারীকে অভিসম্পাত করেন লানত দেন৷ একটি হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছেঃ
لَعَنَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اٰكِلَ الرِّبٰوا وَمُؤْ كِلَهُ وَكَاتِبَهُ وَشَا هِدَيْهِ
لَعَنَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اٰكِلَ الرِّبٰوا وَمُؤْ كِلَهُ وَكَاتِبَهُ وَشَا هِدَيْهِ
অর্থঃ নবি করিম (স.) সুদখোর সুদ দাতা সুদ চুক্তি লেখক ও সুদি লেনদেনের সাক্ষীকে অভিশাপ দিয়েছেন৷ (মুসলিম)।
নবি করিম (স.) অন্যত্র বলেছেনঃ
لَعْنَةُ اللّٰهِ عَلَى الرَّاشِىْ وَالْمُرْتَشِىْ
অর্থঃ ঘুষ প্রদানকারী ও ঘুষ গ্রহণকারী উভয়ের উপরই আল্লাহর অভিসম্পাত৷ (বুখারি ও মুসলিম)।
সুদ ও ঘুষ লেনদেন করার পরিণতিও অত্যন্ত ভয়াবহ৷ এর ফলে মানুষ আল্লাহ তায়ালার শাস্তির যোগ্য হয়ে যায়৷ এমনকি অনেক সময় দুনিয়াতেও আল্লাহ তায়ালা তাদের পাকড়াও করেন৷ মহানবি (স.) বলেনঃ
اِذَاظَهَرَ الزِّنَا وَالرِّ بٰوا فِىْ قَرْيَةٍ فَقَدْاَ حَلُّوْا بِاَنْفُسِهِمْ عَذَابَ اللّٰهِ
অর্থঃ কোন গ্রামে বা দেশে যখন জিনা ব্যভিচার ও সুদ ব্যাপকতা লাভ করে তখন সেখানকার অধিবাসীদের সুদ ও ঘুষের লেনদেনকারীর স্থান হবে জাহান্নাম৷ কিয়ামতের দিন সে ব্যক্তি মহা শাস্তির সম্মুখীন হবে৷
সুদখোরদের অবস্থার বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন যারা সুদ খায় তারা সে ব্যক্তির ন্যায় দন্ডায়মান হবে যাকে শয়তান স্পর্শ দ্বারা পাগল করে৷ এটা এজন্য যে তারা বলে বেচা কেনা তো সুদের মতোই৷ (সূরা বাকারা আয়াত ২৭৫)।
ঘুষখোরদের পরিণতি প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেনঃ
اَلرَّاشِىْ وَالْمُرْتَشِىْ كِلَا هُمَا فِى النَّارِ
অর্থঃ ঘুষদাতা ও ঘুষখোর উভয়ই জাহান্নামি৷ (তাবারানি)।
অন্য হাদিসে রাসুল (স.) ঘুসখোরদের অভিনব শাস্তির বিষয় বর্ণনা করেছেন৷ হাদিস শরিফে এসেছে আয্দ গোত্রের এক ব্যক্তিকে নবি করিম (স.) যাকাত আদায়ের জন্য নিয়োগ করলেন৷ তার ডাকনাম ছিল ইবনুল লুতবিয়্যা৷
সে (যাতাত আদায় করে) ফিরে এসে মহানবি (স.) কে বলল এই মাল আপনাদের আর এই মাল আমাকে উপঢৌকন দেওয়া হয়েছে৷ রাসুলুল্লাহ (স.) মিম্বারে দাঁড়িয়ে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণ প্রকাশ করার পর বলেন যেসব পদের অভিভাবক আল্লাহ আমাকে করেছেন তার মধ্য থেকে কোন পদে আমি তোমাদের কোন ব্যক্তিকে নিয়োগ করি৷
সে আমার কাছে ফিরে এসে বলে এগুলো আপনাদের আর এগুলো আমাকে উপঢৌকন দেওয়া হয়েছে৷ এ ব্যক্তি তার বাবা মায়ের ঘরে বসে থাকে না কেন? যদি সে সত্যবাদী হয় তবে সেখানেই তা তার উপঢৌকন পৌঁছে দেওয়া হবে৷ আল্লাহর শপথ৷ তোমাদের কোন ব্যক্তি অনধিকারে (বা অবৈধভাবে) কোন কিছু গ্রহণ করলে কিয়ামতের দিন সেতা বহন করতে করতে আল্লাহর সামনে হাজির হবে৷
অতএব আমি তোমাদের কাউকে আল্লাহর দরবারে এই অবস্থায় উপস্থিত হতে দেখতে চাই না যে সে উট বহন করবে আর তা আওয়াজ করতে থাকবে অথবা গাভী (বহন করে নিয়ে আসবে আর তা) হাম্বা হাম্বা করতে থাকবে অথবা বকরি (বোঝা বহন করে নিয়ে আসবে আর তা ভ্যা ভ্যা করতে থাকবে৷
অতঃপর তিনি তাঁর দুই হাত এত উপরে উঠালেন যে তাঁর বগলের শুভ্রতা দৃষ্টিগোচর হল৷ তিনি বলেন হে আল্লাহ আমি কি (তোমার হুকুম) পোঁছে দিয়েছি তিনবার তিনি এ কথা বলেন৷ (বুখারি ও মুসলিম)
ইসলামের আলোকে সুদ ও ঘুষের বিধান কি?
ইসলামে সুদ ও ঘুষকে স্পষ্টভাবে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে৷ এগুলো অবৈধ কোন অবস্থাতেই সুদ ঘুষের লেনদেন বৈধ নয়৷ আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেনঃوَاَحَلَّ اللّٰهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبٰوا
অর্থঃ আর আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম৷ (সূরা আল বাকারা আয়াত ২৭৫)।
অন্য আয়াতে এসেছে হে ইমানদারগণ তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় কর৷ তাহলে তোমরা সফলকাম হতে পারবে৷ (সূরা আলে ইমরান আয়াত ১৩০)।
আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন হে ইমানদারগণ তোমরা আল্লাহকে ভয় কর ও সুদের যা বকেয়া আছে তা ত্যাগ কর যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক৷ (সূরা আল বাকারা আয়াত ২৭৮)।
ঘুষের আদান প্রদানও হারাম বা অবৈধ৷ আল্লাহ তায়ালা বলেন তোমরা পরস্পরের ধনসম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কো না এবং মানুষের ধন সম্পত্তির কিয়দংশ অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে জেনেশুনে বিচারকদের নিকট পেশ করো না৷ (সূরা আল বাকারা আয়াত ১৮৮)।
সুদ ও ঘুষ সর্বাবস্থায় হারাম৷ তা গ্রহণ করা যেমন হারাম তেমনি দেওয়া হারাম৷ তেমনিভাবে সুদ দেওয়া ও সুদ নেওয়া উভয়টিই সমান অপরাধ৷ এমনকি সুদের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকাও অপরাধ৷ রাসুল (স.) সুদি কারবারে বা সুদি লেনদেনে সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তিকে অভিশাপ দিয়েছেন৷
বস্তুত সুদ ও ঘুষ খুবই জঘন্য অপরাধ৷ রাসুলুল্লাহ (স.) বহু হাদিসে মানুষকে এ বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন৷ সুদ ও ঘুষের লেনদেন অত্যন্ত গর্হিত কাজ৷ নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ এরূপ কাজ কখনোই করতে পারে না৷ আমরাও জীবনের সর্বাবস্থায় সুদ ও ঘুষের লেনদেন থেকে বিরত থাকব৷