যাকাত কাকে বলে | যাকাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

যাকাত (اَزَّكٰوةُ) কি?

অর্থনৈতিকভাবে ধনী ও গরিব উভয় শ্রেণির মানুষ সমাজে রয়েছে৷ ধনী ও গরিবের মাঝে আর্থিক সমন্বয়সাধন করতে মহান আল্লাহ যাকাতের বিধান বিয়েছেন৷ যাকাত আদায় করলে সমাজের দুর্বল লোকেরাও আর্থিকভাবে সবল হয়ে উঠবে৷ ফলে ধনী ও গরিবের মাঝে সেতুবন্ধ তৈরি হবে৷ 

এতে সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা ও সম্প্রীতি বজায় থাকবে৷ হযরত মুহাম্মদ (স.) যাকাতকে ইসলামের সেতুবন্ধ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেনঃ
اَلزَّكٰوةُ قَنْطَرَةُالْاِسْلَامِ

অর্থঃ যাকাত হল ইসলামের সেতুবন্ধ৷ (বায়হাকি)।

যাকাত শব্দের আভিধানিক অর্থ হল পবিত্রতা পরিশুদ্ধতা ও বৃদ্ধি পাওয়া৷ আর ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে কোন মুসলিম নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে বছরান্তে তার সম্পদের শতকরা ২.৫০ হারে নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করাকে যাকাত বলে৷ নিসাব হল ন্যূনতম সম্পদ যা থাকলে যাকাত ফরজ হয়৷ 
যাকাত
যাকাত

এক্ষেত্রে যাকাত প্রদানে ধনীর সম্পদ পবিত্র পরিশুদ্ধ ও বৃদ্ধি পায়৷ তাই একে যাকাত বলা হয়৷ ইসলামের দৃষ্টিতে যাকাত গরিবের প্রতি ধনীর দয়া নয় বরং এটা গরিবের অধিকার৷ তাই আল্লাহ যাকাত আদায় করাকে আবশ্যক করেছেন৷ আল্লাহর তায়ালা বলেছেনঃ
وَاَقِيْمُواالصَّلٰوةَوَاٰتُوا الزَّكٰوةَ

অর্থঃ তোমরা সালাত কায়েম কর ও যাকাত আদায় কর৷ (সূরা আন নূর আয়াত ৫৬)

যাকাতের গুরুত্ব?

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে অনেক স্থানে সালাতের সাথে যাকাতের কথাও বলেছেন৷ যাকাত ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের মধ্যে তৃতীয়৷ যাকাতের সামাজিক নৈতিক অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব রয়েছে৷ এসব করণেই মহান আল্লাহ মুসলমানদের উপর যাকাত ফরজ করছেন৷

সামাজিক গুরুত্ব?

যাকাত সমাজ থেকে অস্থিতিশীলতা ও বিশৃঙ্খলা দূর করে পারস্পরিক সৌহার্দ স্থাপন করে৷ সামাজিক নিরাপত্তা দানের পাশাপাশি সমাজের মানুষের মাঝে সম্পদের বৈষম্য দূর করে৷ যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
كَىْ لَايَكُوْنَ دُوْلَةًبَيْنَ الْاَغْنِيَآءِ مِنْكُمْ

অর্থঃ যাতে সম্পদ শুধু তোমাদের অর্থশালীদের মধ্যেই আবর্তিত না হয়৷ (সূরা আল হাশর আয়ত ৭)।
সুতরাং সমাজে যাকাত ব্যবস্থা চালু করে বৈষম্য দূর করে সাম্যের ভিত্তিতে জীবন গড়ে তোলাই আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য৷

নৈতিক গুরুত্ব?

যাকাত মানুষের মনে খোদাভীতি সৃষ্টি করে৷ পবিত্র ও উন্নত দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে৷ অপরয় রোধ করতে শেখায়৷ সর্বোপরি যাকাত মানুষের আত্মিক প্রশান্তি নৈতিক উন্নতি সম্পদের পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধতা নিশ্চিত করে৷ যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ
خُذْمِنْ اَمْوَالِهِمْ صَدَقَةًتُطَهِّرُ هُمْ وَتُزَكِّيْهِمْ بِهَا

অর্থঃ আপনি তাদের ধন সম্পদ থেকে সাদাকা (যাকাত) গ্রহণ করুন৷ এর মাধ্যমে আপনি তাদের পবিত্র এবং পরিশোধিত করবেন৷ (সূরা আত তাওবা আয়াত ১০৩)।

অতএব নৈতিকভাবে পরিশুদ্ধ হওয়ার জন্য আমরা যাকাত আদায় করব৷

অর্থনৈতিক গুরুত্ব?

ইসলামি অর্থ ব্যবস্থার উৎসগুলোর মধ্যে যাকাত হল অন্যতম৷ এর উপর ইসলামি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি ও জনকল্যাণমুখী প্রকল্পসমূহের সাফল্য নির্ভরশীল৷ এতে সম্পদের প্রবাহ গতিশীল হয়৷ ধনীর সম্পদ পুঞ্জীভূত না থেকে দরিদ্র লোকদের হাতেও যায়৷ ফলে রাষ্ট্রের অর্থনীতি সচল হয়৷ উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং বেকারত্ব হ্রাস পায়৷ মাথাপিছু আয় বেড়ে যায়৷ 
যাকাত
যাকাত

রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত মজবুত ও শক্তিশালী হয়৷ আর্থিকভাবে অসচ্ছল লোকগুলো ধীরে ধীরে সচ্ছল হতে থাকে৷ দিনে দিনে সম্পদশালী লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়৷ আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
يَمْحَقُ اللّٰهُ الرِّبٰوا وَيُرْبِى الصَّدَقٰتِ

অর্থঃ আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বাড়িয়ে দেন৷ (সূরা আল বাকারা আয়াত ২৭৬)
আমরাও অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য যথাযথভাবে যাকাত আদায়ের চেষ্টা করব৷

ধর্মীয় গুরুত্ব?

কোন মুসলমান যাকাত না দিলে সে আর পরিপূর্ণ মুসলমান থাকতে পারে না আল্লাহ বলেনঃ
اَلَّذِيْنَ لَايُؤْتُوْنَ الزَّكٰوةَوَهُمْ بِالْاٰخِرَةِهُمْ كٰفِرُوْنَ٥

অর্থঃ যারা যাকাত দেয় না এবং তারা পরকালও অস্বীকারকারী৷ (সূরা হা-মীম আস্ সাজদা আয়াত ৭)।
যাকাত অস্বীকার করা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে অস্বীকার করার শামিল৷ ইসলামি আইনে যাকাত দানের উপযুক্ত ব্যক্তিকে অবশ্যই যাকাত দিতে হবে৷ ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা.) যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন৷ 

সালাত ও সাওম শারীরিক ইবাদত৷ আর যাকাত হল আর্থিক ইবাদত৷ সুতরাং যাকাত আদায় করা একজন মুসলিমের ইমানি দায়িত্ব৷

যাকাত অসহায় ও দরিদ্রের অধিকার?

যাকাত প্রদান করা দরিদ্রের প্রতি ধনী লোকের কোন দয়া বা অনুগ্রহ নয়৷ বরং যাকাত হল দরিদ্র লোকের প্রাপ্য বা অধিকার৷ কেউ ইসলামের অনুসারী হলে তার উচিত স্বেচ্ছায় যাকাত প্রদান করা এবং অসহায় লোকদের নিকট তা পৌঁছে দেওয়া৷ মহান আল্লাহ বলেনঃ
وَفِٓىْ اَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِّلسَّآءِلِ وَالْمَحْرُوْمِ٥

অর্থঃ আর তাদের (ধনীদের সম্পদে ভিক্ষুক ও বঞ্চিতের অধিকার রয়েছে৷ (সূরা আয যারিয়াত আয়াত ১৯)।
তাই সম্পদশালী ব্যক্তি তার সম্পদ ভোগ করার পূর্বে চিন্তা করবে যে এতে অসহায়দের অধিকার আছে৷ তাদের অধিকার অবশ্যই দিতে হবে৷ অন্যথায় সমুদয় সম্পদ তার জন্য অপবিত্র হয়ে যাবে৷ 

পরিণামে তাকে পরকালে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে৷ মহান আল্লাহ বলেন আর যারা স্বর্ণ ও রুপা জমা করে রাখে এবং রাখে এবং তা আল্লাহর পথে খরচ করে না তাদেরকে কঠিন শাস্তির সংবাদ দিন৷ (সূরা আত্ তাওবা আয়াত ৩৪)।

আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায় করে বেকার ও গরিবদের জন্য অনেক কর্মসংস্থান করা যেতে পারে৷ এতে দেশ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবে৷ দারিদ্র্য দূরীভূত হবে এবং দেশে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরে আসবে৷ ধনী দরিদ্রের মাঝে সম্পদের বৈষম্য দূর হবে৷ কাজেই ধনীদের শরিয়তের বিধান অনুসারে যাকাত আদায় করা একান্ত আবশ্যক৷
Next Post Previous Post