ইসলামে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কি?
ভ্রাতৃত্ববোধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কি?
ভ্রাতৃত্ববোধ হল ভ্রাতৃত্বসুলভ অনুভূতি প্রকাশ৷ অর্ধাৎ কোন ব্যক্তির অপর ব্যক্তিকে ভাইয়ের ন্যায় মনে করা ভ্রতৃসুলভ আচার আচরণ করা৷ সহোদর ভাইয়ের সাথে আমরা ভালো ব্যবহার করি সবসময় তাদের কল্যাণ কামনা করি তাদের জন্য নিজেদের নানা স্বার্থ ত্যাগ করি তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসি৷তেমনিভাবে দুনিয়ার সকল মানুষের প্রতি এরূপ মনোভাব পোষণ ও নিজ কর্মের মাধ্যমে এর প্রমাণ উপস্থাপনই হল ভ্রাতৃত্ববোধ৷ আর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি হল নানা সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যকার সম্প্রীতি ও ভালোবাসা৷ আমাদের সমাজে বহু ধর্ম বর্ণ ভাষা ও জাতির লোক বাস করে৷ তারা এক একটি সম্প্রদায়৷
সমাজে বসবাসরত এসব সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পর ঐক্য সংহতি ও সহযোগিতার মনোভাবই হল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি৷ মানবসমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভ্রাতৃত্ববোধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ নিজ জীবনে যথাযথভাবে এগুলোর অনুশীলন করে থাকেন৷
![]() |
ইসলামে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি |
ভ্রাতৃত্ববোধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি না থাকলে কোন জাতি উন্নতি করতে পারে না৷ এতদুভয়ের অনুপস্থিতিতে দেশে শান্তি শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয় জাতির উন্নতি বাধাগ্রস্ত হয় এমনকি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়৷ ভ্রাতৃত্ববোধ মানুষকে ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত করে মানুষের মধ্যে সহযোগিতা সহমর্মিতা ইত্যাদি গুণের বিকাশ ঘটায়৷ ফলে মানব সমাজে ঐক্য ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়৷
অন্যদিকে ভ্রাতৃত্ববোধ না থাকলে মানুষ একে অন্যকে ভালোবাসে না অন্যের কল্যাণ কামনা করে না৷ বরং নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য অন্যের প্রতি অন্যায় অত্যাচার ও নির্যাতন করতেও দ্বিধাবোধ করে না৷
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি মানুষের মধ্যে ধৈর্য সহনশীলতা পরমতসহিষ্ণু ইত্যাদি গুণের বিকাশ ঘটায়৷ মানুষ একে অন্যকে শ্রদ্ধা করতে শিখে৷
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি মানুষের মধ্যে ধৈর্য সহনশীলতা পরমতসহিষ্ণু ইত্যাদি গুণের বিকাশ ঘটায়৷ মানুষ একে অন্যকে শ্রদ্ধা করতে শিখে৷
বিভিন্ন ধর্মের জাতির ও সম্প্রদায়ের মানুষ একত্রে বসবাসের ফলে দেশীয় সভ্যতাও উন্নততর হয়৷ সকলের প্রচেষ্টায় দেশ ও জাতি উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করে। পক্ষান্তরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি না থাকলে দেশে মারামারি হানাহানি সূত্রপাত ঘটে৷ অনেক সময় গৃহযুদ্ধ ও শুরু হয়৷ নিজ সম্প্রদায়ের স্বার্থের জন্য দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতেও মানুষ কুণ্ঠিত হয় না৷ বস্তুত দেশের শান্তি ও উন্নতি জন্য ভ্রাতৃত্ববোধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অপরিহার্য উপাদান৷
ইসলামে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কি?
ইসলাম কল্যাণের ধর্ম৷ এর সকল শিক্ষা ও আর্দশ মানবজাতির জন্য চির কল্যাণকর৷ এজন্য ভ্রাতৃত্ববোধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রেও ইসলাম সুস্পষ্ট ঘোষণা প্রদান করছে৷ ইসলামে এতদুভয় বৈশিষ্ট্য ও গুণ অনুশীলনের জন্য সকলকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে৷ইসলামে সকল মুসলমান ভাই ভাই৷ মুসলমানগণ বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুক সে কালো হোক বা সাদা ধনী হোক কিংবা গরিব সকলেই ভাই ভাই৷ আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
اِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ اِخْوَةٌ
অর্থঃ মুমিনগণতো পরস্পর ভাই ভাই৷ (সূরা আল হুজুরাত আয়াত ১০)
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেনঃ
اَلْمُسْلِمُ اَخُو الْمُسْلِمِ
অর্থঃ এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই৷ (বুখারি)।
বিশ্বের সকল মুসলমান ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ৷ তারা পরস্পরের প্রতি ভ্রাতৃত্বসুলভ আচরণ করবে৷ এটাই ইসলামের শিক্ষা৷ একটি হাদিসে মহানবি (স.) মুসলমানদের এ ভ্রাতৃত্বের স্বরূপ তুলে ধরেছেন৷
তিনি বলেন তুমি মুমিনগণকে পারস্পরিক করুণা প্রদর্শন সম্প্রীতি ভালোবাসা ও সহানুভূতি প্রদর্শনের ব্যাপারে একটি দেহের মতো দেখতে পাবে৷ যখন দেহের একটি অঙ্গ কষ্ট পায় তখন গোটা দেহই জ্বর ও নিদ্রাহীনতার মাধ্যমে এর প্রতি সাড়া দেয়৷ (বুখারি ও মুসলিম)।
মুসলমানদের এ পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব হল ইসলামি ভ্রাতৃত্ব৷ ফলে দুনিয়ার দূরতম প্রান্তে কোন মুসলমান কষ্টে পতিত হলে অন্য মুসলমানও তার সমব্যথী হয় তার সাহায্যে এগিয়ে আসে৷
মুসলমানগণের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের পাশাপাশি ইসলাম আরও এক প্রকার ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষা প্রচার করেছে এটি হল বিশ্বভ্রাতৃত্ব৷ অর্থাৎ ইসলামের মতে বিশ্বের সকল মানুষ পরস্পর ভাই ভাই৷ এতে দেশ জাতি ভাষা ও বর্ণের কোন পার্থক্য নেই৷
বরং জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ৷ এ ভ্রাতৃত্ব হল মানুষের মৌলিক ভ্রাতৃত্ব৷ সৃষ্টিগতভাবে মানুষ এ ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ৷ কোন মানুষই এ ভ্রাতৃত্ববোধ লঙ্ঘন করতে পারে না৷ আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
يٰٓاَيُّهَا النَّـاسُ اِنَّاخَلَقْنٰكُمْ مِّنْ ذَكَرٍ وَّاُنْثٰى وَجَعَلْنٰكُمْ شُعُوْبًاوَّقَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوْا ٹ
يٰٓاَيُّهَا النَّـاسُ اِنَّاخَلَقْنٰكُمْ مِّنْ ذَكَرٍ وَّاُنْثٰى وَجَعَلْنٰكُمْ شُعُوْبًاوَّقَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوْا ٹ
অর্থঃ হে মানব মন্ডলী আমি তোমাদের একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি৷ আর তোমাদের বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার৷ (সূরা আল হুজুরাত আয়াত ১৩)। মহানবি (স.) বলেছেনঃ
وَالنَّـاسُ بَنُوْاٰدَمَ وَاٰدَمُ مِنْ تُرَابٍ
অর্থঃ সকল মানুষই আদম (আ.) এর বংশধর আর আদম মাটি থেকে সৃষ্ট৷ (তিরমিযি)।
প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীতে সব মানুষ আদি পিতা হযরত আদম (আ.) ও আদি মাতা হযরত হাওয়া (আ.) এর সন্তান৷ এ হিসেবে সকল মানুষই একই বংশের একই মর্যাদার ও পরস্পর ভাই ভাই৷
সুতরাং জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের প্রতি ভ্রাতৃত্বসুলভ আচরণ করতে হবে৷ সকলকে ভাইয়ের মমতায় দেখতে হবে বিপদে আপদে এগিয়ে আসতে হবে অনেক ধর্ম বা অন্য জাতি বলে কোন মানুষের প্রতি অবিচার করা যাবে না৷ বরং সর্বদা মনে রাখতে হবে যে সকল মানুষের মূলই এক এবং সৃষ্টিগতভাবে সকলেই ভাই ভাই৷
ইহকালীন শান্তির জন্য ভ্রাতৃত্ববোধের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিও বজায় রাখা অপরিহার্য৷ সমাজে বসবাসরত সকল সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করতে হবে৷ নিজ সম্প্রদায়ের বাইরের অন্য সম্প্রদায়ের লোকদের সাথেও সদাচরণ করতে হবে৷ তাদের সাহায্যে সহযোগিতা করতে হবে৷
তাদের বিপদে আপদে এগিয়ে আসতে হবে৷ পারস্পরিক মারামারি হানাহানির পরিবর্তে শান্তি স্থাপনে এগিয়ে আসতে হবে৷ আল্লাহ তায়ালা বলেন তাদের অধিকাংশ গোপন পরামর্শে কোন কল্যাণ নেই৷ বরং কল্যাণ আছে যে দান খয়রাত সৎকাজ ও মানুষের মধ্যে শান্তি স্থাপনের নির্দেশ দেয় তাতে৷ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় যে এরূপ করবে আমি অবশ্যই তাকে মহাপুরস্কার দান করব৷ (সূরা আন নিসা আয়াত ১১৪)।
মানুষের মধ্যে শান্তি স্থাপন করা অত্যন্ত পুণ্যের কাজ৷ এতে আল্লাহ তায়ালা খুশি হন৷ আমরা মুসলমান৷ আমাদের সমাজে অমুসলিম সম্প্রদায়ের বহু লোক বসবাস করেন৷ এদের কেউ আমাদের সহপাঠী কেউ সহকার্মী কেউ খেলার সাথি কেউবা প্রতিবেশী আবার কেউ শিক্ষক বন্ধ বান্ধব পরিচিতজন৷
তাদের সকলের সাথেই ভালো ব্যবহার করতে হবে৷ কেননা তারা সকলেই আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি৷ মহানবি (স.) বলছেনঃ
اَلْخَلْقُ عِيَالُ اللّٰهِ فَـاَحَبُّ الْخَلْقِ اِلَى اللّٰهِ مَنْ اَحْسَنَ اِلٰى عِيَالِهٖ
اَلْخَلْقُ عِيَالُ اللّٰهِ فَـاَحَبُّ الْخَلْقِ اِلَى اللّٰهِ مَنْ اَحْسَنَ اِلٰى عِيَالِهٖ
অর্থঃ সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর পরিজন৷ সুতরাং আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় ঐ ব্যক্তি যে তাঁর পরিজনের প্রতি অনুগ্রহ করে৷ (বায়হাকি)।
অমুসলিম সম্প্রদায়কে তাদের ধর্ম পালনে স্বাধীনতা দিতে হবে৷ তাদের ধর্মগ্রন্থ উপাসনালয় ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রূপ করা যাবে না৷ ধর্ম পালনে তাদের বাধা দেওয়া যাবে না৷ আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
لَـكُمْ دِيْنُـكُمْ وَلِىَ دِيْنِ ٥
অর্থঃ তোমাদের দীন তোমাদের আমার দীন আমার৷ (সূো আল কাফিরুন আয়াত ৬) অন্য আয়াতে এসেছেঃ
لَٓا اِ كْرَاهَ فِى
অর্থঃ দীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি নেই৷ (সূরা আল বাকারা আয়াত ২৫৬)।
ধর্মীয় স্বাধীনতা দানের পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষেত্রেও সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে৷ এ জন্য তাদের প্রতি কোনরূপ অন্যায় অত্যাচার করা যাবে না তাদের সম্পদ দখল করা যাবে না৷ বরং তাদের জান মাল ইজ্জত সংরক্ষণ করতে হবে৷
রাসুলুল্লাহ (স.) এ বিষয়ে মুসলিমগণকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিয়েছেন৷ তিনি বলেছেন যে ব্যক্তি কোন চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমকে হত্যা করল সে জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না৷ অথচ চল্লিশ বছরের দূরত্বে থেকেও জান্নাতের সুঘ্রাণ পাওয়া যায়৷ (বুখারি)।
অন্য হাদিসে তিনি বলেন সাবধান যে ব্যক্তি কোন চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিকের প্রতি অত্যাচার করে অথবা তাকে তার অধিকার থেকে কম দেয় কিংবা ক্ষমতা বহির্ভূতভাবে কোন কাজ চাপিয়ে দেয় বা জোরপূর্বক তার কোন সম্পদ নিয়ে যায় তবে কিয়ামতের দিন আমি সে ব্যক্তির প্রতিবাদকারী হব৷ (অর্থাৎ অমুসলিমের পক্ষ অবলম্বন করব)। (আবু দাউদ)
ইসলাম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য নানা বিষয়ে নির্দেশ প্রদান করেছে৷ আমাদের উচিত জীবনের সকল অবস্থায় এসব নির্দেশ অনুশীলন করা৷ ভ্রাতৃত্ববোধ ও সামাজিক সম্প্রীতির আদর্শে সকলে পরিচালিত হলে এ গোটা বিশ্ব শান্তময় হয়ে উঠবে৷