গীবত কাকে বলে | গীবত ও চোগলখোরী | গীবতের গুনাহ মাফের উপায়
বর্তমান সময়ে গিবত একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। আমরা সকলেই কমবেশি প্রায় এর সাথে জড়িত। মানুষ একজনের দোষ ও ক্রটি অন্য মানুষের কাছে বলে বেড়ানোতে খুব তৃপ্তি ও আনন্দ অনুভব করে থাকেন। অথচ গীবত এমন একটি বদভ্যাস যা পুরো সমাজ ব্যবস্থাকে ধবংস করে দেয়।
![]() |
গীবত |
গীবত
এমন এক নেশার বস্তু যা মুমিনের নেক আমলকে খারিজ করে দেয়। গীবত হল জঘন্যতম
একটি অপরাধ। গিবত করা হল মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সমান। আর তাই আমাদেরকে
অবশ্যই গীবত বা পরচর্চা থেকে ১০০ হাত দূরে থাকতে হবে।
গীবত শব্দের অর্থ কি?
গিবত আরবি শব্দ৷ এর অর্থ পরনিন্দা পরচর্চা, অসাক্ষাতে দুর্নাম করা, সমালোচনা করা, অপরের দোষ প্রকাশ করা, কুৎসা রটনা করা ইত্যাদি৷গীবত কাকে বলে?
ইসলামি পরিভাষায় কারও অনুপস্থিতিতে অন্যের নিকট এমন কোন কথা বলা যা শুনলে সে মনে কষ্ট পায় তাকে গিবত বলে৷ প্রচলিত অর্থে অসাক্ষাতে কারও দোষ বলাকে গিবত বলা হয়৷ একটি হাদিস মহানবি (স.) সুন্দরভাবে গিবতের পরিচয় বর্ণনা করেছেন৷ একদা নবি (স.) বললেন তোমরা কি জানো গিবত কী? সাহাবিগণ বললেন আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভাল জানেন৷ রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন গিবত হল তুমি তোমরা ভাইয়ের এমনভাবে আলোচনা করবে যা শুনলে সে মনে কষ্ট পায়৷অতঃপর
রাসুলুল্লাহ (স.) কে বলা হল আমি যা বলব তা যদি আমরা ভাইয়ের মধ্যে পাওয়া
যায় সেক্ষেত্রেও কি তা গিবত হবে? উত্তরে রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন তুমি যা
বলছ তা যদি তার মধ্যে থাকে তবে তা গিবত হবে৷ আর যদি তা তার মধ্যে না পাওয়া
যায় তবে তা হবে অপবাদ৷ (মুসলিম)
সাত প্রকার লোকের সমালোচনা করলে গিবত হয় না?
শরীয়তে
গিবত করা কবীরাহ গুনাহর অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ পাক সূরা হুজুরাত-এর ১২ নম্বর
আয়াতে মধ্যে গিবত করতে নিষেধ করেছেন ও গীবত করাটাকে মৃত ভাইয়ের গোশত
খাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন।
এ আয়াতের তাফসীরে
হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম গাযযালী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেনঃ কয়েক প্রকার
লোক রয়েছে যাদের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করলে গিবত হয় না। সেগুলো নিচে বর্ণনা করা হলঃ
এক
কোন
লোক যদি কাজী ছাহেবের কাছে বিচারের জন্য যায় ও বিচারের জন্য যদি সে সত্য
কথা বলতে গিয়ে বিপরীত পক্ষের দোষ ও ত্রুটি বর্ণনা করে। তাহলে সেটা গিবত হবে
না।
দুই
কোন
লোক যদি মুফতী ছাহেবের কাছে যায় ফতওয়ার জন্য তখন সত্য কথা বলতে গিয়ে যদি
বিপরীত পক্ষের দোষ ও ত্রুটি বর্ণনা করে তাহলে সেটা গিবত হবে না।
তিন
যারা রাজা বাদশাহ, আমীর উমারা তাদের সংশোধনের জন্য যদি তাদের দোষ ও ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দেয়া হয়। তাহলে সেটা গিবত হবে না।
চার
যারা ফাসিক তাদের দোষ ও ত্রুটি বর্ণনা করলে গিবত হবে না। ফাসিক হচ্ছে ঐ ব্যক্তি যে ফরয, ওয়াজিব, সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ তরক করে থাকে।
পাঁচ
কোন লোক লুলা-ল্যাংড়া, বোবা তোতলা হিসেবে মশহুর তাকে যদি লুলা ল্যাংড়া, বোবা, তোতলা বলে ডাকা হয়, তাহলে তা গিবত হবে না।
ছয়
কোন
পিতা তার ছেলেকে বিয়ে করাতে চায় বা মেয়েকে বিয়ে দিতে চাই তখন বিপরীত
পক্ষের ছেলে কিংবা মেয়ের প্রতিবেশীর কাছে গিয়ে যদি ঐ ছেলে কিংবা মেয়ে
সম্বন্ধে সংবাদ নেয়।
আর প্রতিবেশীর লোকেরা যদি সত্য কথা বলতে গিয়ে সেই ছেলে বা মেয়ের দোষ ও ত্রুটিগুলো বলে দেয়, তাহলে তা গীবত হবে না।
সাত
যারা
উলামায়ে ছূ’ অর্থাৎ দুনিয়াদার আলিম কিংবা মাওলানা, মুফতি, যারা দুনিয়াবী
স্বার্থ হাছিলের উদ্দেশ্যে শরীয়তের খিলাফ মনগড়া ফতওয়া দিয়ে থাকে ও আমল করে
থাকেন।
গিবতের স্বরূপ?
আমরা অনেক সময় অলস বসে থাকি৷ হাতে কোন কাজ থাকে না৷ বন্ধুবান্ধব মিলে গল্প করি৷ এসময় কথায় কথায় অন্যের সমালোচনা করি৷ সহপাঠী, বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজনের দোষ ত্রুটি খুঁজে বেড়াই৷ তাদের নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রূপ করি৷ বস্তুত এসবই গিবত৷ ঠাট্টাচ্ছলে গল্প করার সময় এসব কথার দ্বারা অনেক বড় গুনাহ হয়৷ তবে শুধু কথায় মাধ্যমেই নয় বরং আরও নানা ভাবে গিবত হতে পারে৷যেমনঃ
লেখনীর মাধ্যমে ইশারা ইঙ্গিতে কিংবা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে কারও সমালোচনা
করা৷ কারও কোন অভ্যাস নিয়ে চিত্র লেখা বা কার্টুনের মাধ্যমেও গিবত করা যায়৷
কারও কোন দোষ আলোচনা করা গববতের সবচেয়ে পরিচিত রূপ৷ এছাড়াও শারীরিক দোষ
ক্রটি পোশাক পরিচ্ছদের সমালোচনা, জাত বংশ নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রূপ করা, কারও
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও অভ্যাস নিয়ে সমালোচনা করা ইত্যাদি গিবতের
অন্তর্ভুক্ত৷
গিবতের কুফল ও পরিণাম?
ইসলামি শরিয়তে গিবত বা পরনিন্দা করা অবৈধ৷ আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃوَلَا يَعْتَبْ بَّعْضُكُمْ بَعْضًا اَيُحِبُّ اَحَدُ كُمْ اَنْ يَّاْ كُلَ لَحْمَ اَخِيْهِ مَيْتًا فَكَرِ هْتُمُوْهُ
অর্থঃ আর তোমরা একে অন্যের গিবত করে না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে ভালোবাসবে? বস্তুত তোমরা নিজেরাই তা অপছন্দ থাকো৷ (সূরা আল-হুজুরাত আয়াত ১২)। গিবত করাকে আল-কুরআনে নিজ মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে৷ সুতরাং গিবত খুবই অপছন্দনীয় কাজ৷ সুস্থ বিবেকবান কোন মানুষই এরূপ কাজ পছন্দ করতে পারে না৷ আল্লাহ তায়ালাও গিবত করা পছন্দ করেন না৷
পবিত্র
হাদিসে মহানবি (স.) আমাদের গিবতের পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন৷
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন গিবত ব্যভিচারের চাইতেও মারাত্মক৷ সাহাবিগণ বললেন
হে আল্লাহর রাসুল গিবত কীভাবে ব্যভিচারের চাইতেও মারাত্মক অপরাধ হয়? রাসুল
(স.) বললেন কোন ব্যক্তি ব্যভিচার করার পর তওবা করলে আল্লাহ তায়ালা তাকে
ক্ষমা করে দিতে পারেন৷
কিন্তু
গিবতকারীকে ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ মাফ করবেন না যতক্ষণ না যার গিবত করা
হয়েছে সে ব্যক্তি মাফ করবে৷ (বায়হাকি)। ইসলামি শরিয়তে গিবত সম্পূর্ণরূপে
হারাম৷ কারও গিবত করা যেমন হারাম তেমনি গিবত শোনাও হারাম গিবত না করার
পাশাপাশি গিবত শোনা থেকেও বিরত থাকতে হবে৷ গিবতকারীকে গিবত বলা থেকে বিরত
থাকার জন্য বলতে হবে৷ নতুবা যেমব স্থানে গিবতের আলোচনা হবে সেসব স্থান
এড়িয়ে চলতে হবে৷
গিবতের
পাপ অত্যন্ত ভয়াবহ৷ আমরা অনেক সময় এমন ব্যক্তির গিবত করে থাকি যার নিকট
ক্ষমা চাওয়ারও সুযোগ নেই৷ যার ফলে গিবতের এ পাপ আল্লাহও ক্ষমা করবেন না৷
সুতরাং বলা যায় আমরা গিবত করা থেকে বিরত থাকব৷ যদি কোন কারণে তা হয়ে যায় তব
সাথে সাথে গিবতকৃত ব্যক্তির নিকট থেকে ক্ষমা চেয়ে নেব৷
গীবতের গুনাহ মাফের উপায়?
যদি
কোন সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির গিবত করে থাকেন, তবে তাঁর কাছে থেকে ক্ষমা নিতে
হবে। কারণ হচ্ছে এটা তাঁর হকের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁর হক
নষ্ট করেছেন ও তাঁর হকের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে তাঁর কাছে থেকে ক্ষমা অব্যশই
নিতে হবে।
এখন যদি ক্ষমা নেওয়ার কাজটি আপনার
সাধ্যের বাইরে চলে যায় কিংবা তিনি মারা গিয়ে থাকেন। তবে আল্লাহ তাআলার কাছে
তওবা করুন ও আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। হতে পারে আল্লাহ তাআলা
তার বান্দাদের হকগুলো পরিপূর্ণ করে দিতে পারেন।