হজ কি | হজ্জের ইতিহাস ও তাৎপর্য | হজ পালনের নিয়মাবলী

হজ শব্দের অর্থ কি?

হজ ইসলামের পঞ্চম ভিক্তি। হজ আরবি শব্দ৷ এর আভিধানিক অর্থ সংকল্প করা, ইচ্ছা করা ইত্যাদি৷ 

হজ কি?

ইসলামি পরিভাষায় আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য জিলহজ মাসের নির্ধারিত দিনসমূহে নির্ধারিত পদ্ধতিতে বাইতুল্লাহ (আল্লাহর ঘর) ও সংশ্লিষ্ট স্থানসমূহ যিয়ারত করাকে হজ বলে। হজ ঐ সকল ধনী-মুসলমানের উপর ফরয যাদের পবিত্র মক্কায় যাতায়াত ও হজের কাজ সম্পাদন করার মতো আর্থিক ও দৈহিক সামর্থ্য রয়েছে। 

আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্য পবিত্র কাবাঘর ও সংশ্লিষ্ট স্থানসমূহে বিশেষ কার্যাদি সম্পাদন করাকে হজ বলে। হজ একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক ও শারীরিক ইবাদত। যিলহজ মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত মক্কা, মিনা, আরাফা এবং মুযদালিফায় আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (স.) এর নির্দেশ মোতাবেক বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করাও হজের অন্তর্ভুক্ত৷

হজ পালন
হজ পালন

প্রত্যেক সুস্থ, প্রাপ্তবয়ষ্ক, বুদ্ধিমান ও সামর্থ্যবান মুসলিম নরনারীর উপর জীবনে একবার হজ আদায় করা ফরজ৷ এরপর যতবার হজ করবে তা নফল হিসেবে গণ্য হবে এবং অনেক সাওয়াবের অধিকারী হবে হজ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঐ গৃহে হজ করা তার অবশ্য কর্তব্য৷ (সূরা আলে ইমরান আয়াত ৯৭)।

যেসব লোক কাবাঘর পর্যন্ত যাতায়াতের দৈহিক ক্ষমতা রাখে এবং হজ হতে ফিরে আসা অবধি পরিবারবর্গের আবশ্যকীয় ব্যয় বাদে যাতায়াতের খরচ বহন করতে সক্ষম তাদের উপর হজ ফরজ৷ মহিলা হাজি হলে একজন সঙ্গী থাকতে হবে৷ সঙ্গী হবেন স্বামী অথবা এমন আত্মীয় যার সাথে বিবাহ সম্পর্ক হারাম৷ যেমন বাবা ছেলে ভাই চাচা মামা ইত্যাদি৷ সফরসঙ্গীর ব্যয়ভার মহিলা হাজিকেই বহন করতে হবে৷

হজ্জের ইতিহাস ও তাৎপর্য?

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে সালাত অন্যতম। সালাত আদায় ও আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশের জন্য পৃথিবীতে সর্বপ্রথম মক্কা নগরীতে যে ঘর (ইবাদতখানা) তৈরি হয় তার নাম বাইতুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর৷ কালক্রমে এ পবিত্র ঘর জনমানবশূন্য হয়ে পড়ে৷

প্রায় চার হাজার বছর আগের কথা৷ ইরাকে জন্ম নেওয়া আল্লহর নবি হযরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর আদেশে বিবি হাজেরা ও শিশুপুত্র ইসমাইল (আ.) কে কাবাঘরের নিকটবর্তী জনমানবশূন্য স্থানে রেখে যান৷ বিবি হাজেরা স্বামীকে লক্ষ করে বললেনঃ
আমাদের এমন মরু প্রান্তরে ফেলর রেখে কেন চলে যান?উত্তরে তার স্বামী বললেন আল্লাহর নির্দেশ৷ বিবি হাজেরা বললেন তাহলে আল্লাহর ইচ্ছাই পূর্ণ হোক৷ তিনি অবশ্যই আমাদের বাঁচিয়ে রাখবেন৷ যাওয়ার সময় হযরত ইবরাহিম (আ.) তাঁদের জন্য দোয়া করলেন ৷

হে আমাদের প্রতিপালক! আমি আমার বংশের কতককে বসবাস করালাম অনুর্বর উপত্যকায় তোমার পবিত্র ঘরের নিকট৷ হে আমাদের প্রতিপালক এ জন্য যে তারা যেন সালাত কায়েম করে৷ অতএব তুমি কিছু লোকের অন্তর তাদের প্রতি অনুরাগী করে দাও এবং ফল ফলাদি দ্বারা তাদের রিযিকের ব্যবস্থা করে দাও যেন তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে (সূরা ইবরাহীম আয়াত ৩৭)।

নবি ইবরাহিম (আ.) এর প্রার্থনা আল্লাহ তায়ালা কবুল করলেন৷ হযরত ইবরাহিম (আ.) এর রেখে যাওয়া সামান্য খাদ্য ও পানীয় কয়েক দিনের মধ্যেই ফুরিয়ে গেল৷ মা ও শিশু পুত্র ক্ষধা পিপাসায় কাতর৷ মা হাজেরা নিকটস্থ সাফা পাহড়ে উঠে চারিদিকে তাকিয়ে দেখেন। আবার মারওয়া পাহাড়ের চূড়ায় উঠে চারিদিকে তাকান কোথাও কোন কাফেলা দেখা যায় কি না যাতে তাদের নিকট থেকে সামান্য পানি নিয়ে পিপাসা কাতর পুত্রের মুখে দেওয়া যায়৷ 

কিস্তু কোথাও কোন জনমানবের চিহ্নও দেখা গেল না৷ এমনিভাবে সাতবার সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে দৌড়াদৌড়ি করলেন৷ তারই নিদর্শনস্বরূপ হাজিগণ ঐ স্থানে (সাঈ) দ্রুত হাঁটেন৷ মা হাজেরা কোথাও পানির সন্ধান না পেয়ে শিশুর কাছে ফিরে এসে বিস্ময়ে দেখলেন নিকটেই মাটি ফুঁড়ে স্বচ্ছ পানির ফোয়ারা বইছে৷ এ পানির ফোয়ারাই ছিল বিখ্যাত যমযম কূপের উৎস৷ 

বিবি হাজেরা শিশু ইসমাইলকে পানি পান করিয়ে তার তৃষ্ণা নিবারণ করলেন৷ নিজেও তৃপ্তিসহকার পানি পান করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন৷ মরুভূমিতে যেখানে পানি থাকে সেখানে আকাশে পাখি ওড়ে৷ দূর হতে তা দেখে কাফেলা এসে জমা হয়৷ জুরহুম বংশের এক বাণিজ্য কাফেলা এসে মা হাজেরার অনুমতি নিয়ে সেখানে বসবাস শুরু করল৷

ক্রমে আরও লোকজন জড়ো হল৷ সকলের বিশ্বাস এ পুণ্যাত্মা মা ও শিশুর কল্যাণেই আল্লাহ তায়ালা এ ঊষর মরুর বুক চিরে পানির ঝর্ণা প্রবাহিত করছেন৷ ধীরে ধীরে মক্কা একটি জনপদে পরিণত হল৷ হযরত ইসমাইল যখন কিশোর বয়সে উপনীত হলেন তখন ইবরাহিম (আ.) একটি অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হলেন৷ পুত্র ইসমাইলকে কুরবানি করার জন্য আল্লাহ তায়ালা তাঁকে আদেশ করলেন৷ 

আল্লাহ তায়ালাকে খুশি করার জন্য হযরত ইবরাহিম (আ.) আপন পুত্রকে কুরবানি করতে প্রস্তুত হয়ে এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন৷ তারপর আল্লাহ তায়ালা ইবরাহিম (আ.) কে কাবাঘরের স্থানটি দেখিয়ে তা পুনঃনির্মাণের আদেশ দিলেন৷ ইবরাহিম (আ.) পুত্র ইসমাইলকে সাথে নিয়ে পবিত্র কাবাঘর পুনঃনির্মাণ করেন৷ তারপর এ দোয়া করেনঃ
رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا ٹ اِنَّكَ اَنْتَ السَّمِيْعُ الْعَلِِيْمُ٥

অর্থঃ হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের এ কাজ কবুল করুন৷ নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞাত৷ (সূরা আল বাকারা আয়াত ১২৭)।

এরপর আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে হযরত ইবরাহিম (আ.) মানুষকে হজের জন্য আহবান করেন৷ পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছেঃ
وَاَذِْنْ فِيْ النَّاسِ بِالْحَجِّ يَاْتُوْكَ رِ جَا لاًوَّعَلٰ كُلِّ ضَا مِرٍ يَّاْ تِبْنَ مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِيْقٍ٥

অর্থঃ এবং আপনি মানুষের নিকট হজের ঘোষণা করে দিন তারা আপনার নিকট আসবে পদব্রজে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উষ্ট্রের পিঠে তারা আসবে দূর দূরান্তের পথ অতিক্রম করে৷ (সূরা আল হাজ্জ আয়াত ২৭)।

হযরত ইবরাহিম (আ.) এর আহ্বানে কাবা শরিফ আবার তাওহিদপন্থীদের পুণ্যভূমিতে পরিণত হল৷ হযরত ইবরাহিম (আ.) চলে গেলেন আপন কর্মক্ষেত্রে৷ আর হযরত ইসমাইল (আ.) রয়ে গেলেন মক্কায়৷ পরবর্তীকালে তিনিও নবি হলেন৷ মৃত্যুর সময় কাবার দায়িত্বভার অপর্ণ করে গেলেন আপন বংশধরের উপর৷ 

কালক্রমে তারা আল্লাহকে ভুলে গিয়ে মূর্তিপূজা শুরু করল৷ কাবাগৃহে তারা স্থাপন করল ৩৬০টি মূর্তি৷ হাজের সময় ইবরাহিম (আ.) এর প্রথাগুলো পালিত হতো। তবে তারা পূজা অর্চনা করত প্রতিমার সামনে৷ উত্তরাধিকার সূত্রে কুরাইম বংশ তখনো কাবার রক্ষক এবং হজের তত্ত্বাবধায়ক ছিল৷ যার ফলে দেশ বিদেশে ছিল তাদের যথষ্ট সম্মান৷ 

আর এ বংশেই জন্মগ্রহণ করেন আমাদের প্রিয় নবি হযরত মুহাম্মদ (স.)৷ বাল্যকাল থেকে তিনি মূর্তিপূজাকে অপছন্দ করতেন৷ মক্কায় অতি অল্পসংখ্যক লোক তখনো মূর্তিপূজাকে ঘৃণা করতেন৷ তাঁদের বলা হতো হানিফ বা একনিষ্ঠ৷ তাঁরা মূর্তি পূজা না করে ইবরাহিমি হজ পালন করতেন৷ মক্কা বিজয়ের পর নবি করিম (স.) পুনরায় ইবরাহিমি হজ চালু করেন৷

হজের তাৎপর্য?

সারাবিশ্বের মুসলিম জাতির মহাসম্মেলন৷ বিশ্বের সকল মুসলিম যে এক উম্মত, হজ মৌসুমে মক্কায় এর বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায়৷ পৃথিবীর সকল দেশের মুসলমানগণ আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় নির্দিষ্ট দিনগুলোতে মক্কায় একত্র হয়। সম্মিলিতভাবে অনুষ্ঠান পালন করে৷ সকলের ধর্ম এক উদ্দেশ্য এক কর্মসূচিও এক৷ 

সকলের পরিধানে একই ধরনের সাদা পোশাক৷ ভাষা, বর্ণ, জীবন পদ্ধতির বিভিন্নতা সত্ত্বেও তারা সকলে একই ধ্বনি উচ্চারণে একাকার হয়ে যায়৷ সকলের হৃদয়ে এক আল্লাহর নাম৷ এতে পৃথিবীর সব দেশের লোকের পরস্পর মিলনের সুযোগ হয়৷ পরস্পরের মধ্যে ভাবের আদান প্রদান হয়৷ প্রয়োজনীয় সমস্যা সমাধানের সুযোগ হয়৷ এভাবে হজ সারাবিশ্বের মুসলমানকে সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করে৷

প্রতি বছর হাজিদের হজে গমন ও প্রত্যাবর্তনের ফলে মুসলিম জাহানের প্রত্যেক অঞ্চলে মুসলমানের প্রাণে এক অভিনব আলোড়ন সৃষ্টি হয়৷ ইসলামের প্রাণচাঞ্চল্য পরিবেশ বজায় রাখার জন্য হজের যে এক বিরাট অবদান আছে এর মাধ্যমে তা বাস্তবে প্রতিফলিত হয়৷

হজের ফজিলত?

ইসলামে প্রত্যেকটি ইবাদতেরই যথেষ্ট গুরুত্ব ও ফজিলত রয়েছে৷ হজেরও অনেক গুরুত্ব ও ফজিলত রয়েছে৷ হজের গুরুত্ব সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেনঃ
مَنْ حَجَّ لِلّٰهِ فَلَمْ يَرْ فُثْ وَلَمْ يَفْسُقْ رَجَعَ كَيَوْمٍ وَّلَدَتْهُ اُمُّهُ

অর্থঃ যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহ যিয়ারতে এসে কোন অশ্লীল কাজ করল না আল্লাহর অপছন্দনীয় কোন কাজে লিপ্ত হল না সে গুণাহ বা পাপ থেকে এমনভাবে পবিত্র হয়ে ফিরল যেমন সে পবিত্র ছিল সেদিন, যেদিন সে তার মায়ের পেট থেকে জন্মগ্রহণ করেছিল৷ (বুখারি ও মুসলিম)।

পবিত্র মক্কা শরীফ
পবিত্র মক্কা শরীফ

তিনি আরও বলেন তোমরা হজ ও উমরাহ পর পর করতে থাক৷ কারণ এ দুইটি ইবাদত দারিদ্র্য অভাব এবং গুনাহগুলোকে এমনভাবে দূর করে দেয় যেমন আগুনের ভাটি লোহা, সোনা ও রূপার ময়লা দূরীভূত করে তা বিশুদ্ধ করে দেয়৷ হজে মাবরুরের (মাকবুল) প্রতিদান হচ্ছে একমাত্র জান্নাত (নাসাঈ) যে মুসলমানদের উপর হজ ফরজ তাদের উচিত খুশি মনে হজ পালন করা৷

হজ্জের ফরজ ও ওয়াজিব কয়টি?

হজের ফরজ তিনটিঃ
  • হজের নিয়েতে ইহরাম বাঁধা৷
  • আরাফার ময়দানে ৯ই জিলহজ তারিখ অবস্থান (ওকূফ) করা৷
  • তাওয়াফে যিয়ারত করা৷

হজের ওয়াজিবসমূহ?

হজের ওয়াজিব কাজ সাতটিঃ
  • আরাফার ময়দান হতে প্রত্যাবর্তনের সময় মুযদালিফায় অবস্থান করা৷
  • সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝখানে দৌড়ানো বা সাঈ করা৷
  • শয়তানকে (জামরাতুল আকাবায় )কংকর নিক্ষেপ করা৷
  • তাওয়াফে বিদা অর্থাৎ মক্কার বাইরে থেকে আগত হাজিদের জন্য বিদায়কালীন তাওয়াফ করা৷ একে তাওয়াফুল বিদা (বিদায়ী তাওয়াফও) বলে৷
  • মাথা মুড়ানো বা চুল ছাঁটা৷
  • কুরবানি করা৷
  • দম দেওয়া৷

হজের সুন্নতসমূহ কি কি?

হজের অনেক সুন্নত রয়েছে৷ নিচে কয়েকটি সুন্নাত উল্লেখ করা হলঃ
  • বহিরাগতদের জন্য তাওয়াফে কুদুম (আগমনী তাওয়াফ ) করা৷
  • হাজরে আসওয়াদ থেকে তাওয়াফ শুরু করা৷
  • জিলহজ মাসের ৭ তারিখে ইমামের মক্কায় হজ সম্পর্কে খুতবা প্রদান করা৷ ৯ তারিখ আরাফায় দ্বিপ্রহরের পর খুতবা প্রদান করা৷ একাদশ তারিখে মিনায় খুতবা দেওয়া৷
  • ৮ই জিলহজে মক্কা থেকে মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করা মিনায় উপস্থিত হয়ে যোহর থেকে ৯ই জিলহজের ফজর পর্যন্ত অবস্থান করে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা৷
  • ৯ই জিলহজে সূর্য ওঠার পর মিনা থেকে আরাফার দিকে রওয়ানা করা৷  সম্ভব হলে আরাফাতে গোসল করা৷
  • ইহারাম বাঁধার আগে গোসল করা৷
  • মুযদালিফায় রাত কাটানোর পর ফজরের নামায আদায় করে সূর্য উদয়ের পূর্বে মিনার দিকে রওয়ানা করা৷
  • জিলহজ মাসের ১১,১২তারিখে কংকর নিক্ষেপ (রামি) এর জন্য মিনাতে রাতযাপন করা৷
  • জিলহজ মাসের ১১,১২,ও ১৩ তারিখে ক্রমধারা ঠিক রেখে কংকর নিক্ষেপ করা৷

হজ পালনের নিয়ম?

ইসলামের প্রতিটি কাজ নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে আদায় করতে হয়৷ হজ আদায়েরও নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে৷ নিম্নে হজ পালনের নিয়মাবলি ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করা হলঃ
ইহরাম

ইহরাম কি?

ইহারাম আরবি শব্দ৷ এর অর্থ নিষিদ্ধ৷ নামাযের উদ্দেশ্য যেমন তাহরিমা বাঁধতে হয় হজের জন্যও তেমনি ইহরাম বাঁধতে হয়৷ এটি হজের আনুষ্ঠানিক নিয়ত৷ শাওয়ালা মাসের প্রথম তারিখ থেকে জিলহজ মাসের ৯ তারিখ পর্যন্ত যেকোনো দিন ইহারাম বাঁধা যায এ সময় ছাড়া অন্য সময় ইহরাম বাঁধলে হবে না৷ 

এ সময় ইহরামের পোশাক পরবে ও কিবলামুখী হয়ে সরবে তালবিয়া পাঠ করবে৷ হজ মৌসুম ছাড়া অন্য সময় যদি কেউ কাবাঘর যিয়ারতের উদ্দেশ্য মক্কা গমনের ইচ্ছা করে তবে দাকেও হজের ইহরাম বাঁধার স্থান (মিকাতে) পৌঁছে ইহরাম বাঁধতে হবে৷

তাওয়াফে কুদুম (আগমনি তাওয়াফ) কি?

ইহারাম বাঁধার পর মক্কা পৌঁছে কাবাঘরের চারধারে তাওয়াফ করতে হয়৷ অর্থাৎ সাতবার ঘুরতে হয়৷ মক্কা শরিফ পৌছার পর এটি প্রথম তাওয়াফ৷ এ কারণে একে তাওয়াফে কুদুম বা আগমনি তাওয়াফ বলা হয়৷ হাজরে আসওয়াদ হতে তাওয়াফ শুরু করতে হয়৷

সাঈ

আগমনি তাওয়াফ শেষ করে কাবাঘরের অনতিদূরে অবস্থিত সাফা ও মাওয়া পাহাড়ের মাঝের পথটি সাতবার অতিক্রম করতে হয়৷ একে বলা হয় সাঈ৷ সাফা পাহাড় থেকে সাঈ শুরু করে মারওয়া পাহাড়ে শেষ করতে হয়৷ তারপর ইহারাম অবস্থায় জিলহজ মাসের সাত তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়৷ 

আর এ সময়ের মধ্যে যতবার ইচ্ছা তাওয়াফ করা যায় এগুলো নফল তাওয়াফ৷ সাঈ করার প্রয়োজন নেই৷ নফল তাওয়াফে অনেক সাওয়াব পাওয়া যায়৷

৭ই জিলহজ

এ তারিখে যোহরের নামাযের পর ইমাম খুতবা দেন৷ আর এ খুতবায় তিনি হজ সম্পর্কীয় জ্ঞাতব্য বিষয় বিশেষ করে ৮ তারিখ মিনায় এবং ৯ তারিখ আরাফাতে করণীয় বা আহকাম সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় নিয়ম কানুন বর্ণনা করেন৷

৮ই জিলহজ

এ তারিখে হাজিগণ সূর্যোদয়ের পর মিনায় আসেন৷ মিনায় যাওয়ার পূর্বে সুন্নাত অনুযায়ী গোসল করে ও ইহরামের চাদর পরে মসজিদুল হারাম বা বায়তুল্লাহ শরিফে আসেন৷ 

ইহারাম ও নিয়তের সাথে সাথেই তালবিয়া পাঠ করতে কনতে মিনায় যেতে হয়৷ সেখানে পরের দিন পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা সুন্নাত৷

৯ই জিলহজ

নবম তারিখ আরাফায় দিবস৷ এদিন সকালেই আরাফায় অবস্থানের উদ্দেশ্য মিনায় ফজরের নামায আদায় করে আশরাফার ময়দানের দিকে রওয়ানা করতে হয়৷ একারণে ইমামের পেছনে যোহরের ওয়াক্ত যোহর ও আসর উভয় নামায এরসঙ্গে আদায় করতে হয়৷ নামাযের পূর্বে ইমাম খুতবা দেন৷ খুতবায় হজের বাকি বিধিবিধান বর্ণনা করনে৷ 

আরাফার ময়দানে অবস্থান হজের একটি ফরজ কাজ৷ ৯ তারিৎ অথবা অনিবার্য কারণর ৯ তারিখের রাত পরবর্তী সুবহি সাদিকের পূর্বে কোন সময়ে এক মুহুর্তের জন্য হলেও আরাফার মাঠে অবস্থান করতে হয়৷ অন্যথায় হজ হবে না৷ এদিন সূর্যাস্তের সাথে সাথে আরাফার মাঠ থেকে মুযদালিফায় ফিরে আসতে হয়৷ 

মুযদালিফায় পৌঁছে এশার নামাযের সময়ে মাগরিব ও এশা এক সঙ্গে আদায় করতে হয়৷ এ রাত মুযদালিফায় কাটাতে হয়৷

১০ই জিলহজ 

দশম দিন কুরবানির দিন৷ এদিন সকালে সূর্যোদয়ের পূর্বে হাজিগণ মিনার পথে রওয়ানা হয়৷ মিনার এক স্থানে শয়তানের প্রতিকৃতি হিসেবে পরপর তিনটি পাকা স্তম্ভ আছে৷ সেখানে পৌঁছে এদিন বড় শয়তানের প্রতিকৃতিকে লক্ষ্য করে সাতটি কংকর নিক্ষেপ করতে হয়৷ কংকরগুলো ছোলা পরিমাণ বড় হতে হয়৷ 

হযরত ইবরাহিম(আ.) যখন আল্লাহর ইঙ্গিতে প্রাণপ্রিয় একমাত্র পুত্র ইসমাইল (আ.) কে কুরবানি করতে যাচ্ছিলেন তখন শয়তান পিতা পুত্রের মনে সংশয়ের সৃষ্টি করে তাঁদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালিয়েছিল৷ তারা বিরক্ত হয়ে শয়তানের প্রতি পাথর নিক্ষেপ করেছিলেন৷ আল্লাহর প্রতি তাঁদের ভালোবাসা ও নিষ্ঠার প্রতি সম্মান দেখিয়ে হাজিগণ এ পাথর নিক্ষেপ করে থাকেন৷

কংকর নিক্ষেপের পর এ মিনাতে কুরবানি করতে হয়৷ কুরবানির পর হাজিবগণ মাথা কামিয়ে ইহরাম থেকে মুক্ত হন৷ চুল ছোট করলেও চলে তবে সমস্ত মাথায় চুল সমপরিমাপে কাটাতে হয়৷ মেয়েদেরকে চুলের অগ্রভাগের কিছুটা কাটালেই চলে৷ তারপর ঐ তারিখেই অথবা ১১ কিংবা ১২ তারিখে মক্কা ফিরে কাবাঘর তাওয়াফ করতে হয়৷ 

এ তাওয়াফকে তাওয়াফে যিয়ারত বলা হয়৷ এটি হজের একটি ফরজ কাজ৷ মক্কায় প্রথম প্রবেশের সময় যদি সাফা ও মারওয়ায় সাঈ না করে থাকে। তবে এ তাওয়াফের পর সাঈ করতে হয়৷ আগে করে থাকলে আর প্রয়োজন হয় না। তারপর মিনায় ফিরে যেতে হয় এবং সেখানেই ১১ ও ১২ তারিখ থাকতে হয়৷

১১ ও ১২ তারিখ দুপুরের পর মিনার তিনটি স্তম্ভের প্রতিটিতে সাতটি করে কংককর মারতে হয়৷ তারপর ইচ্ছে করলে ১২ তারিখেই মক্কায় ফিরে আসতে পারেন৷  যদি কেউ মিনায় থেকে যান তবে তাঁকে ১৩ তারিখ দুপুরের পর তিনটি স্তম্ভে পাথর নিক্ষেপ করে মক্কায় ফিরতে হয়৷ 

আর এভাবে হজের কার্যাবলি সমাপ্ত করতে হয়৷ যারা বহিরাগত তাদের সর্বশেষ কাজ হচ্ছে বিদায়ী তাওয়াফ করা৷ একে তাওয়াফুল বিদা বা প্রত্যবর্তনকালীন তাওয়াফও বলে৷ বহিরাগতদের জন্য এ তাওয়াফ ওয়াজিব৷ 

হজের ত্রুটি ও তা সংশোধনের উপায়?

হজ পালনকালে অনিচ্ছায়ও অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি বা নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটতে পারে৷ এই ত্রুটির কোনটি গুরুতর আবার কোনটি সাধারণ পর্যায়ের হয়ে থাকে৷ হজের ওয়াজিব পালনের ধারাবাহিকতার ব্যতিক্রম ঘটলে "দম" ওয়াজিব হয়৷ যেমনঃ মাথা মুগুনের পূর্বে শয়তানকে কংকর নিক্ষেপ করা৷

হাজীগণ
হাজীগণ

আর দম হচ্ছে একটি ছাগল ভেড়া বা দুম্বা কুরবানি করা৷ উট গরু বা মহিষের এক সপ্তমাংশও এর স্থলাভিষিক্ত হতে পারে৷ সাধারণতভাবে ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজগুলো বা হারাম শরিফ এলাকায় নিষিদ্ধ কোন কাজ করলে প্রতিকার স্বরূপ দম বা কুরবানি করেত হয়৷ আবার কোন কোন ক্ষেত্রে সাদাকা দিতে হয়৷

সাম্য ও বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় হজের ভূমিকা?

হজ একান্তই ব্যক্তিগত ইবাদত৷ আল্লাহর প্রেমিক হাজিগণ আল্লাহর নৈকট্য ও ভালোবাসা লাভের জন্য হজ করে থাকেন৷  তা সত্ত্বেও সামাজিক সাংস্কৃতিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এর যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে৷ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা মিসলিম সম্প্রদায় হজের মৌসুমে বিশেষভাবে ধর্মীয় ও নৈতিক চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে৷ 

যাঁরা হজে যান তাঁদের মন ধর্মীয় চেতনায় উদ্দীপ্ত থাকে অনুরূপভাবে যাঁরা তাঁদের বিদায় সম্ভাষণ জানাতে আসে তাঁদের মধ্যেও ধর্মীয় চেতনাশক্তি জাগ্রত হয়৷ হাজিগণ যে স্থান দিয়ে গমন করেন তাঁদের লাব্বাইক ধ্বনি শুনে সেখানকার অনেক মানুষের মনও হজের প্রতি আগ্রহী হয়৷

বিভিন্ন দেশ হতে আগত হাজিদের শারীরিক অবকাঠামো ভাষা ও সংস্কৃতি ভিন্ন কিন্তু মিকাতের (ইহরাম বাঁধার স্থান ) কাজে এসে একই ধরনের কাপড় পরিধান করে৷ সবার মুখে একই ধ্বনি প্রতিধ্বনিত করে আকাশ বাতাস মিখরিত করে তোলা৷ মক্কা ও মদিনায় একত্র হয়ে একই ইমামের পেছনে নামায আদায় করে সমবেত মুসলিম জনতা ভাষা জাতি দেশ ও গোত্রের কৃত্রিম বৈষম্য ভেঙে দিয়ে বিশ্বভ্রাতৃত্ব স্থাপনের বিরাট সুযোগ পায়৷

মানুষের মনে সাম্যের ধারণা জন্মায়৷ হজের এই মহাসম্মেলন পৃথিবীর সব শ্রেণির মানুষই এসে সমবেত হয়৷ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আদান প্রদান ঘটে৷ ভাব বিনিময় হয৷ বিশ্বশান্তি স্থাপনে এবং জাতিসমূহের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব কলহ মিটিয়ে ভালোবাসা বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্ব স্থাপনের বিশেষ সুযোগ পায়৷ হজের এ শিক্ষা মানবসমাজে বাস্তবায়িত হলে মানুষের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ হানাহানি মারামারি দূর হয়ে পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা মমত্ববোধ ও সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সৃষ্টি হবে৷  
Next Post Previous Post