আত্মশুদ্ধি বলতে কি বুঝায় | আত্মশুদ্ধির ইসলামী পদ্ধতি
আত্মশুদ্ধি কি?
আত্মশুদ্ধি অর্থ হল নিজের সংশোধন নিজেকে খাঁটি করা পরিশুদ্ধ করা ইত্যাদি৷ ইসলামি পরিভাষায় সর্বপ্রকার অনৈসলামিক কথা ও কাজ থেকে নিজ অন্তরকে মুক্ত ও নির্মল রাখাকে আত্মশুদ্ধি বলা হয়৷ আল্লাহ তায়ালার স্মরণ আনুগত্য ও ইবাদত ব্যতীত অন্য সমস্ত কিছু থেকে অন্তরকে পবিত্র রাখাকেও আত্মশুদ্ধি বলা হয়৷আত্মশুদ্ধি আরবি পরিভাষা হল তাযকিয়াতুন নাফস৷ একে সংক্ষেপে তাযকিয়াহ ও বলা৷ স্বীয় আত্মাকে সবধরনের পাপ পংকিলতা ও অনৈতিক কর্মকান্ড থেকে মুক্ত রাখাই তাযকিয়াহ এর উদ্দেশ্য৷
আত্মশুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা?
মানুষের জন্য আত্মশুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য৷ বস্তুত দেহ ও অন্তরের সমন্বয়ে মানুষ গঠিত৷ দেহ হল মানুষের হাত পা মাথা বুক ইত্যাদি নানা অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সমষ্টি৷ আর অন্তর হল আত্মা বা কালব৷ এ দুটোর মধ্যে কালবের ভূমিকাই প্রধান৷ মানুষের অন্তর যেরূপ নির্দেশনা প্রদান করে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তদ্রূপই কাজ করে থাকে৷সুতরাং মানুষের কাজকর্মের শুদ্ধতার জন্য প্রথমেই কালবের সংশোধন প্রয়োজন৷ আর কালবের সংশোধনই হল আত্মশুদ্ধি৷ কালব যদি সৎ ও ভালো কাজের নির্দেশ দেয় তবে দেহও ভালো কাজ করে৷ একটি হাদিসে মহানবি (স.) সুন্দরভাবে এ বিষয়টি বর্ণনা করেছেন৷
তিনি বলেছেন জেনে রেখা শরীরের মধ্যে একটি গোশতপিন্ড রয়েছে৷ যদি তা সংশোধিত হয়ে যায় তবে গোটা শরীরই সংশোধিত হয়৷ আর যদি তা কলুষিত হয় তবে গোটা শরীরই কলুষিত হয়ে যায়৷ মনে রেখো তা হল কালব বা অন্তর৷ (বুখারি ও মুসলিম)।
আল্লাহ তায়ালা মানুষকে তাঁর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করছেন৷ আর ইবাদতের পূর্বশর্ত হল পবিত্রতা কেননা আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং পবিত্র৷ তিনি পবিত্রতা ব্যতীত কোন জিনিসই কবুল করেন না৷ সুতরাং ইবাদতের জন্যও দেহ মন পবিত্র হওয়া আবশ্যক৷
দৈহিক পবিত্রতা লাভ করলেই হবে না বরং অন্তরকেও পবিত্র করতে হবে৷ অন্য সবকিছু থেকে মনকে পবিত্র রেখে কেবল মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইবাদাত করতে হবে৷ আর অন্তর আত্মার পবিত্রতা আত্মশুদ্ধির মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব৷
মানুষের আত্মিক প্রশান্তি উন্নতি ও বিকাশ সাধনের জন্যও আত্মশুদ্ধির গুরুত্ব অপরিসীম৷ আত্মশুদ্ধি মানুষের নৈতিক ও মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটায়৷ সদা সর্বদা ভালো চিন্তা ও সৎকর্মে উৎসাহিত করে৷ আত্মশুদ্ধি মানুষের চরিত্রে প্রশংসনীয় গুণাবলি চর্চার সুযোগ করে দেয়৷
পক্ষান্তরে যার আত্মা কলুষিত সে নানাবিধ পাপ চিন্তা ও অশ্লীল কাজে লিপ্ত থাকে৷ সে অন্যায় অত্যাচার সন্ত্রাস নির্যাতন করতে দ্বিধাবোধ করে না৷ ফলে সামাজিক শান্তি শৃঙ্খলাও বিনষ্ট হয়৷ অতএব নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ রক্ষা ও বিকাশের জন্য আত্মশুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য৷
আত্মশুদ্ধির গুরুত্ব?
আত্মশুদ্ধি মানুষকে বিকশিত করে সফলতা দান করে৷ ইহজীবনে আত্মশুদ্ধি মানুষকে পূর্ণাঙ্গ মানুষে পরিণত করে৷ এরূপ মানুষ সবধরনের কুপ্রবৃত্তি থেকে বেঁচে থাকে সকল পাপাচার ও অনৈতিক কাজ থেকে দূরে থাকে৷ ফলে সমাজে সে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে সকলের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা লাভ করে৷বস্তুত আত্মশুদ্ধি হল সফলতা লাভের মাধ্যমে৷ যে ব্যক্তি আত্মশুদ্ধি অর্জন করতে ব্যর্থ সে দুর্ভাগা৷ সে কখনোই সফলতা লাভ করতে পারে না৷ আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
قَدْ اَفْلَحَ مَنْ زَكّٰهَا ٥ وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسّٰهَا
অর্থঃ নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আত্মাকে পূত পবিত্র রাখবে সেই সফলকাম হবে আর সে ব্যক্তিই ব্যর্থ হবে যে নিজেকে কলুষিত করবে৷ (সূরা আশ শামস আয়াত ৯-১০)।
পরকালীন জীবনের সফলতা এবং মুক্তিও আত্মশুদ্ধির উপর নির্ভরশীল যে ব্যক্তি দুনিয়াতে নিজ আত্মাকে পবিত্র রাখবে পরকালে সেই মুক্তি লাই করবে৷ তার জন্য পুরস্কার হবে জান্নাত৷ আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
يَوْمَ لَايَنْفَعُ مَالٌ وَّلَابَنُوْنَ٥ اِلَّا مَنْ اَتَى اللّٰهَ بِقَلْبٍ سَلِيْمٍ ٥
অর্থঃ সেদিন ধনসম্পদ কোন কাজে আসবে না আর না কাজে আসবে সন্তান সন্তুতি৷ বরং সেদিন সে ব্যক্তিই মুক্তি পাবে যে আল্লাহর নিকট বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ নিয়ে আসবে৷ (সূরা আশ শুআরা আয়াত ৮৮-৮৯)।
মূলত হই ও পরকালীন সফলতা আত্মশুদ্ধির মাধ্যমেই অর্জন করা যায়৷ এজন্যই ইসলামে আত্মশুদ্ধির প্রতি অত্যধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে৷
আত্মশুদ্ধির উপায়?
মানুষের অন্তর হল স্বচ্ছ কাঁচের মতো৷ যখনই মানুষ কোন খারাপ কাজ করে তখনই তাতে একটি কালো দাগ পড়ে৷ এভাবে বারংবার পাপ কাজ করার দ্বারা মানুষের অন্তর পুরোপুরি কলুষিত হয়ে যায়৷ আল্লাহ তায়ালা এ সম্পর্কে বলেছেনঃكَلَّا بَلْ رَانَ عَلٰى قُلُوْبِهِمْ مَّا كَانُوْا يَكْسِبُوْنَ٥
অর্থঃ ❝কখনোই নয় বরং তাদের কৃতকর্মই তাদের অন্তরে মরিচা ধরিয়েছে৷❞ (সূরা আল মুতাফ্ফিফিন আয়াত ১৪)।
মানুষের কাজের কারণেই মানুষের অন্তর কলুষিত হয়৷ সুতরাং আত্মশুদ্ধির প্রধান উপায় হল খারাপ কাজ ত্যাগ করা এবং কুচিন্তা কুঅভ্যাস বর্জন করা৷ সদাসর্বদা সৎকর্ম সৎচিন্তা নৈতিক ও মানবিক আদর্শে নিজ চরিত্র গড়ে তোলার দ্বারা আত্মশুদ্ধি অর্জন করা যায়৷
মহানবি (স.) বলেছেন প্রত্যেক বস্তুরই পরিশোধক যন্ত্র রয়েছে৷ আর অন্তর পরিস্কারের যন্ত্র হল আল্লাহর যিকির৷ (বায়হাকি)।
বেশি বেশি আল্লাহ তায়ালার স্মরণ ও যিকিরের মাধ্যমে অন্তরের কালো দাগ ও মরিচা দূর করা যায়৷ যিকিরের মাধ্যমে আত্মা প্রশান্ত ও পরিশুদ্ধ হয়৷ এ ছাড়াও তওবা ইস্তিগফার তাওয়াক্কুল যুহ্দ ইখলাস সবর শোকর কুরআন তিলাওয়াত সালাত ইত্যাদির মাধ্যমেও আত্মশুদ্ধি অর্জন করা যায়৷
আমরা আত্মাকে পরিশুদ্ধ করব আত্মশুদ্ধি অর্জন করব এবং মহান আল্লাহর প্রিয়পাত্র হব৷