নারীর প্রতি সম্মানবোধ কি | নারীর প্রতি সম্মানবোধের উপায়

নারীর প্রতি সম্মানবোধ কি?

নারীর প্রতি সম্মানবোধ আখলাকে হামিদকহ অন্যতম৷ এটি একটি মহৎগুণ৷ নারীর প্রতি সম্মানবোধ ব্যাপক অর্থবোধক৷ সাধারণ অর্থে এটি নারীকে সম্মান প্রদর্শনের অনুভূতি বা মনোভাবকে বুঝিয়ে থাকে৷ আর ব্যাপকার্থে নারীর প্রতি সম্মানবোধ হল নারী জাতির প্রতি সম্মানজনক মনোভাব৷ 

যেমন সৃষ্টির বিচারে নর ও নারীর সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রদান নারী বলে কাউকে ছোট মনে না করা নারী হিসেবে কাউকে ঠাট্টা বিদ্রূপ না করা৷ বরং যথাযথভাবে তাদের প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদা প্রদান করা তাদের কাজ করার সুযোগ প্রদান করা তাদের মাল সম্পদ ইজ্জত সম্মানের সংরক্ষণ করা ইত্যাদি নারীর প্রতি সম্মানবোধের প্রকৃত উদাহরণ৷

নারীর প্রতি সম্মানবোধের গুরুত্ব ও তাৎপর্য?

ইসলামে নারীদের প্রভূত সম্মান দেওয়া হয়েছে৷ আমাদের প্রিয়নবি (স.) এর আবির্ভাবের পূর্বে সারা বিশ্বজগৎ বিশেষ করে আরব সমাজ অজ্ঞতা ও বর্বরতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল৷ সে সময় নারীদের কোন মান মর্যাদা ছিল না৷ তাদের কোনরূপ অধিকার ছিল না৷ সেসময় নারীদের দ্রব্যসামগ্রী মনে করা হতো৷ 

তাদের ক্রীতাদাসী হিসেবে বাজারে কেনাবেচা করা হতো৷ তারা ছিল ভোগ্যপণ্য আনন্দদায়ক প্রেমদায়িনী সকল ভাঙনের উৎস নরকের দরজা অনিবার্য পাপ ইত্যাদি নামে খ্যাত৷ এমনকি কোন সভ্যতায় তাদের বিষধর সাপের সাথে তুলনা করা হতো৷ অনেক সময় নারীদের মানুষ হিসেবে গণ্য করা হতো না৷
নারীর প্রতি সম্মানবোধ
নারীর প্রতি সম্মানবোধ

তৎকালীন আরবের লোকেরা কন্যা সন্তানের জন্মকে অপমানজনক মনে করত ও কন্যা শিশুকে জীবন্ত কবর দিত৷ আল কুরআনে আল্লাহ তায়ালা তাদের এ হীন কাজের কথা উল্লেখ করেছেন৷ আল্লাহ বলেন যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয় তখন তার মুখমণ্ডল কালো হয়ে যায় এবং অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট হয়৷ (সূরা আন নাহল আয়াত ৫৮)।

ইসলাম নারীদের এহেন অপমানকর অবস্থা থেকে মুক্তি দান করছে ইসলামই সর্বপ্রথম নারীদের অধিকার ও মর্যাদা দান করছে৷ জীবনের নানা ক্ষেত্রে নারীদের অবদান ও ভূমিকার স্বীকৃতি প্রদান করছে৷ মানুষক নারীর প্রতি সম্মানবোধের আদেশ করছে নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে ইহকালীন ও পরকালীন সফলতা লাভের দিকনির্দেশনা প্রদান করছে৷

ইসলামে নারীর মর্যাদা ও সম্মান?

সৃষ্টিগতভাবে ইসলামে নর নারীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই বরং মানুষ হিসেবে তারা উভয়ই সমান মর্যাদার অধিকারী৷ আল্লাহ তায়ালা নর নারী উভয়ের মাধ্যমেই মানবজাতির বিস্তার ঘটিয়েছেন৷ এতে কারও একার কৃতিত্ব নেই৷ বরং উভয়েই সমান মর্যাদা ও কৃতিত্বের অধিকারী৷ আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
يٰٓاَيُّهَا النَّاسُ اِنَّا خَلَقْنٰكُمْ مِّنْ ذَكَرٍ وَّاُنْثَىٰ

অর্থঃ হে মানব সম্প্রদায় আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও নারী থেকে৷ (সূরা আল হুজুরাত আয়াত ১৩)।

ধর্মীয় স্বাধীনতা মর্যাদা ও আধ্যাত্নিক উন্নতি সাধনের ক্ষেত্রেও ইসলাম নারীকে পুরুষের সমান সম্মান ও অধিকার প্রদান করছে৷ ধর্মীয় কর্তব্য পালন ও ফল লাভের ক্ষেত্রে নর নারীতে কোনরূপ পার্থক্য করা হয়নি৷ 

আল্লাহ তায়ালা বলেন ইমান গ্রহণ করে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে ই সৎকর্ম করবে সেই জান্নাতে প্রবেশ করবে৷ এ ব্যাপারে কারও প্রতি বিন্দুমাত্র অবিচার করা হবে না৷ (সূরা আন নিসা আয়াত ১২৪)।

পারিবারিক ও সামাজিক জীবনেও ইসলাম নারীদের মর্যাদা ও সম্মানের ঘোষণা প্রদান করেছে৷ মা হিসেবে নারীকে সন্তানের কাছে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদান করছে৷ রাসুলুল্লাহ (স.) ঘোষণা করেছেনঃ
اَلْجَنَّةُ تَحْتَ اَقْدٰامِ الْاُمَّهَاتِ

অর্থঃ মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত৷ (মুসনাদে শিহাব আল কাযায়ি)।

অন্য একটি হাদিসে এসেছে একদা জনৈক সাহাবি রাসুলুল্লাহ (স.) কে জিজ্ঞাসা করলেন আমার সদ্ব্যবহার পাওয়ার সবচেয়ে বেশি হকদার কে? তিনি বললেন তোমার মাতা ঐ সাহাবি পূনরায় জিজ্ঞাসা করলেন অতঃপর কোন ব্যক্তি? রাসুল (স.) বললেন তোমার মাতা৷ 

এভাবে পরপর তিনবার এরূপ প্রশ্ন করলে রাসুল (স.) একই উত্তর দিলেন৷ চতুর্থবারে রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন তোমার পিতা৷ এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে সন্তানের উপর পিতার চাইতেও মাতার অধিকার তিন গুণ বেশি৷ এটি মা হিসেবে নারীর অনন্য মর্যাদার পরিচায়ক৷

কন্যা হিসেবেও নারীর মর্যাদা অপরিসীম৷ ইসলাম কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দেওয়া হারাম করেছে৷ তাদের ভালোভাবে প্রতিপালনের জন্য নির্দেশ প্রদান করেছে৷ স্ত্রী হিসেবে নারীর মর্যাদা ও সম্মান স্বামীর অনুরূপ৷ আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِىْ عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوْفِ

অর্থঃ নারীদের তেমনই ন্যায়সংগত অধিকার আছে যেমন আছে তাদের উপর পুরুষদের৷ (সূরা অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
هُنَّ لِبَاسٌ لَّـكُمْ وَاَنْتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ ٹ

অর্থঃ তারা (নারীগণ) তোমাদের ভূষণ আর তোমরা তাদের ভূষণ৷ (সূরা আল বাকারা আয়াত ১৮৭)।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইসলাম নারীদের অধিকার ও মর্যাদা সংরক্ষণ করেছে৷ নারীগণ স্বাধীনভাবে অর্থ উপার্জন করতে পারবে৷ পিতা মাতার সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার হিসেবেও তারা সম্পদ লাভ করবে৷ তাদের সম্পত্তিতে শুধু তাদেরই কর্তৃত্ব থাকবে৷ 

তারা তাদের ধন সম্পদ স্বাধীনভাবে ব্যয় করতে পারবে৷ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন পুরুষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ এবং নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ৷ (সূরা আন নিসা আয়াত ৩২)।

এভাবে মানবজীবনের সকল ক্ষেত্রেই ইসলাম নারী জাতির অধিকার ও মর্যাদা ঘোষণা করেছে৷ ব্যক্তিগত পারিবারিক সামাজিক জাতীয় আন্তর্জাতিক সকল ক্ষেত্রেই ইসলাম নারীদের এ অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে৷

নারীর প্রতি সম্মানবোধ উপায়?

নারীর প্রতি সম্মানবোধ মানুষের উত্তম মন মানসিকতার পরিচয়ক৷ শুধু অন্তর দ্বারা সম্মান ও মর্যাদা দেখালেই চলবে না বরং নিজ কাজ কর্ম ও আচার ব্যবহার দ্বারা এর প্রমাণ দিতে হবে৷ আমাদের পরিবারে ও আত্মীয়স্বজনের মধ্যে যেমন মা মেয়ে বোন স্ত্রী দাদি ফুফু খালা রয়েছেন তেমনি শিক্ষিকা সহপাঠী ও নারী সহকর্মী রয়েছেন৷ 

এদের সাথে সুন্দর ব্যবহার করা যথাযথ শ্রদ্ধা সম্মান ও মায়া মমতা প্রদর্শন জীবন ও সম্রমের নিরাপত্তা ও অধিকার প্রদান করা ইত্যাদি নারীর প্রতি সম্মানবোধের নিদর্শন৷ আল কুরআন ও হাদিসে এ ব্যাপারে আমাদের নানা নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে৷ রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেনঃ
فَاتَّقُوا اللّٰهَ فِى النِّسَآءِ

অর্থঃ তোমরা স্ত্রীলোকদের ব্যাপারে আল্লাহকে অবশ্যই ভয় করে চলবে৷ (মুসলিম)৷ অর্থাৎ তাদের সাথে খারাপ আচরণ করবে  না যথাযথভাবে তাদের হক আদায় করবে৷ বিদায় হজের ভাষণেও মহানবি (স.) নারী জাতির অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বিশেষভাবে তাগিদ দিয়েছেন৷

স্ত্রীদের প্রতি সম্মানজনক আচরণ করার জন্য আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ
وَعَاشِرُوْهُنَّ بِالْمَعْرُوْفِ

অর্থঃ তোমরা স্ত্রীদের সাথে উত্তম ব্যবহার করে জীবনযাপন করবে৷ (সূরা আন নিসা আয়াত ১৯)।

রাসুলুল্লাহ (স.) স্ত্রীদের প্রতি ভালো ব্যবহারকারীদের উত্তম উম্মত হিসেবে বর্ণনা করছেন৷ তিনি বলেনঃ
خَيْرُ كُمْ  خَيْرُ كُمْ لِاَهْلِهٖ

অর্থঃ তোমাদের মধ্যে সেই উত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম৷ (তিরমিযি)।

অন্য একটি হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন নিশ্চয়ই পূর্ণাঙ্গ ইমানের অধিকারী ঐ মুমিন ব্যক্তি যে তাদের মধ্যে উত্তম চরিত্রের অধিকারী ও নিজ পরিবারের প্রতি অধিক সদয়৷ (তিরমিযি)।

বস্তুত নারীদের প্রতি উত্তম ব্যবহার করা মুমিনের নিদর্শন৷ নারীর প্রতি সম্মানবোধ না থাকলে ইমান পূর্ণ হয় না৷ আমাদের প্রিয়নবি (স.) নারীদের শ্রদ্ধা করতেন সম্মান করতেন এবং স্ত্রী ও মেয়েদের ভালো বাসতেন৷ একদা তিনি সাহাবিগণকে নিয়ে বসা ছিলেন৷ 

এ সময় হযরত হালিমা (রা.) তাঁর নিকট আসলেন৷ হযরত হালিমা ছিলেন মহানবি (স.) এর দুধমাতা৷ নবি করিম (স.) তাঁকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন৷ নিজ চাদর বিছিয়ে দিয়ে তাঁকে বসতে দিলেন৷ তাঁর কুশলাদি জিজ্ঞাসা করলেন৷ এভাবে প্রিয়নবি (স.) তাঁকে শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখালেন৷

কন্যা সন্তান প্রসঙ্গে নবি করিম (স.) বলেছেন যে ব্যক্তির কোন কন্যা সন্তান থাকে আর সে তাকে জীবন্ত কবর দেয় না তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে না অন্য সন্তান অর্থাৎ ছেলে সন্তানকে কন্যা সন্তানের উপর প্রাধান্য দেয় না সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে৷ (আবু দাউদ)।

অন্য একটি হাদিসে এসেছে একদা জনৈক সাহাবি রাসুলুল্লাহ (স.) কে জিজ্ঞাসা করলেন আমাদের উপর স্ত্রীদের কী অধিকার রয়েছে? তিনি উত্তরে বললেন তুমি যা খাবে তাদেরও তা ই খাওয়াবে যা পরিধান করবে তাদেরও তা ই পরিধান করাবে তাদের মুখমণ্ডলে আঘাত করবে না তাদেন গালিগালাজ করবে না আর গৃহ ব্যতীত অন্য কোথাও তাদের বিচ্ছিন্ন রেখো না৷ (আবু দাউদ)।

নারীর প্রতি সম্মানবোধ আখলাকে হামিদাহ-র অন্যতম৷ পূর্ণাঙ্গ নৈতিক ও মানবিক গুণাবলি অর্জনের জন্য এ গুণ থাকা আবশ্যক৷ অন্তর থেকে নারীদের সম্মান করতে হবে মায়া মমতা শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে এবং স্ত্রী ও মেয়েদের ভালোবাসতে হবে৷ পাশাপাশি নিজ আচরণ ও কাজকর্ম দ্বারাও এর প্রমাণ দিতে হবে৷ 

নারীদের কোনোরূপ অত্যাচার করা যাবে না ঠাট্টা বিদ্রূপ তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা যাবে না ইভটিজিং করা যাবে না তারা মনে কষ্টনপায় বা তাদের সম্মানহানি হয় এরূপ কোন কাজ করা যাবে না৷ বরং সদাসর্বদা তাদের প্রাপ্য ও অধিকার আদায় করতে হবে৷ প্রয়োজনমতো তাদের সাহায্য সহযোগিতা করতে হবে৷ তাদের মেধা বিকাশের সুযোগ দিতে হবে ৷ 

উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য তাদের উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করতে হবে৷ এভাবে নারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা যায়৷ এতে আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্ট হন৷ তাহলে আমরা দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা লাভ করতে পারব৷
Next Post Previous Post