সম্রাট আওরঙ্গজেবের জীবনী

মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীর ছিলেন এক শক্তিশালী ও দীর্ঘতম সময় শাসনকারী শাসক। তার শাসনামলে মুঘল সাম্রাজ্য ভৌগোলিকভাবে সর্বোচ্চ বিস্তারে পৌঁছেছিল, তবে একইসঙ্গে এটি দুর্বলতার পথেও এগিয়ে যায়। 
সম্রাট আওরঙ্গজেব
সম্রাট আওরঙ্গজেব
কঠোর ধর্মীয় নীতি, সামরিক দক্ষতা এবং প্রশাসনিক শৃঙ্খলার কারণে তিনি একদিকে যেমন সফল শাসক ছিলেন, অন্যদিকে তার কঠোর নীতি বিদ্রোহ ও অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিল। ইতিহাসে তিনি এক বিতর্কিত চরিত্র, যিনি একাধারে দক্ষ সামরিক নেতা, কঠোর শাসক এবং ধর্মপ্রাণ মুসলিম হিসেবে পরিচিত। 

তার শাসনামলের রাজনৈতিক, সামরিক ও ধর্মীয় নীতি মুঘল সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

সম্রাট আওরঙ্গজেবের জীবনী?

  • পুরো নামঃ আবুল মুজাফফর মুহিউদ্দিন মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব আলমগীর
  • জন্মঃ ৩ নভেম্বর ১৬১৮, দোহাদ, গুজরাট
  • মৃত্যুঃ ৩ মার্চ ১৭০৭, আহমদনগর, দাক্ষিণাত্য
  • পিতাঃ সম্রাট শাহজাহান
  • মাতাঃ মুমতাজ মহল
  • শাসনকালঃ ১৬৫৮ - ১৭০৭ (প্রায় ৫০ বছর)
  • উল্লেখযোগ্য নীতিঃ শরিয়া আইন বাস্তবায়ন, জিজিয়া কর পুনর্বহাল, সামরিক অভিযানের মাধ্যমে সাম্রাজ্যের বিস্তার।

প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা?

আওরঙ্গজেব ১৬১৮ সালে মুঘল সাম্রাজ্যের রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সম্রাট শাহজাহান এবং মা মুমতাজ মহল। 

তিনি ছোটবেলা থেকেই ইসলামি শিক্ষা লাভ করেন এবং আরবি ও ফারসি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। তরুণ বয়স থেকেই তিনি প্রশাসনিক ও সামরিক বিষয়ে দক্ষ হয়ে ওঠেন।

সামরিক দক্ষতা ও ক্ষমতা দখল?

১৬৩৬ সালে আওরঙ্গজেবকে দাক্ষিণাত্যে সুবেদার নিযুক্ত করা হয়। তার সামরিক দক্ষতার জন্য তিনি দ্রুত শাহজাহানের বিশ্বস্ততা অর্জন করেন। ১৬৫৭ সালে শাহজাহান গুরুতর অসুস্থ হলে তার ছেলেদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়। 

আওরঙ্গজেব তার বড় ভাই দারা শিকোহকে পরাজিত ও হত্যা করেন এবং ১৬৫৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে মুঘল সিংহাসনে বসেন। তিনি তার অন্য ভাই মুরাদ ও শাহ সুজাকেও পরাজিত করেন এবং বাবাকে বন্দি করে আগ্রার কিলায় আটকে রাখেন।

শাসনকাল (১৬৫৮ - ১৭০৭)

১. সামরিক অভিযানে সফলতা ও সাম্রাজ্যের বিস্তার

আওরঙ্গজেব ছিলেন একজন দক্ষ সামরিক শাসক। তার আমলে মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়।

উত্তরে

কাশ্মীর, আফগানিস্তান পর্যন্ত শক্তিশালী মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।

পশ্চিমে

রাজপুত ও অন্যান্য বিদ্রোহী শক্তিকে দমন করেন।

দক্ষিণে

বিজাপুর, গোলকুন্ডার শাসকদের পরাজিত করে দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত সাম্রাজ্যের বিস্তার করেন। তবে দক্ষিণ ভারতের মারাঠাদের সঙ্গে তার সংঘর্ষ দীর্ঘস্থায়ী হয়। 

শিবাজী তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। আওরঙ্গজেব শিবাজীকে বন্দি করলেও তিনি পালিয়ে যান এবং মারাঠা প্রতিরোধ আরও শক্তিশালী হয়।

২. ধর্মীয় নীতি ও শাসন ব্যবস্থা

আওরঙ্গজেব ছিলেন একজন কট্টর সুন্নি মুসলিম এবং ইসলামি আইন (শরিয়া) কঠোরভাবে অনুসরণ করতেন।

জিজিয়া কর পুনর্বহাল

অমুসলিমদের জন্য কর (জিজিয়া) পুনরায় চালু করেন, যা আকবর বাতিল করেছিলেন।

মন্দির ভাঙা

তার শাসনামলে কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির ও কিছু হিন্দু উপাসনালয় ধ্বংস করা হয়, যা অনেক বিতর্কের জন্ম দেয়। তবে কিছু হিন্দু মন্দিরও সংরক্ষিত রাখা হয়েছিল।

শরিয়াভিত্তিক আইন

তিনি রাজস্ব ব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থা শরিয়া আইনের ভিত্তিতে পরিচালিত করতেন। তবে তার কঠোর ধর্মীয় নীতির ফলে হিন্দু রাজারা ক্ষুব্ধ হন, যা মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে উসকে দেয়।

৩. প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক নীতি

আওরঙ্গজেব ছিলেন ব্যয়ের ক্ষেত্রে সংযমী ও সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত।

অতিরিক্ত রাজকীয় ব্যয় কমানো

নিজে কুরআন লিখে বিক্রি করতেন এবং সরকারি কোষাগার থেকে অতিরিক্ত ব্যয় করতেন না।

সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি

দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের কারণে সাম্রাজ্যের রাজস্ব সংকট দেখা দেয়।

অত্যধিক কর ও দমননীতি

জনগণের ওপর করের বোঝা বাড়ানো হয়, যা বিদ্রোহের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

মৃত্যু ও মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা?

১৭০৭ সালে আহমদনগরে আওরঙ্গজেব মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তিনি একাকী ছিলেন এবং তার কবরের জন্য কোনো জাঁকজমকপূর্ণ সমাধি তৈরি করতে বলেননি।
তার মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্য দ্রুত দুর্বল হতে শুরু করে। 

উত্তরাধিকার নিয়ে তার ছেলেদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। মারাঠারা আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং ব্রিটিশ ও অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তির প্রভাব বাড়তে থাকে।

শেষ কথা

আওরঙ্গজেব ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের সর্বশেষ শক্তিশালী সম্রাট। তিনি সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটালেও তার কঠোর ধর্মীয় নীতি, দীর্ঘ যুদ্ধ এবং আর্থিক দুর্বলতা মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পথ তৈরি করে। 

ইতিহাসে তাকে একজন দক্ষ শাসক হিসেবে দেখা হয়, তবে তার কঠোর নীতির কারণে তিনি বিতর্কিতও ছিলেন।

Next Post Previous Post