পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়ার দোয়া
কোন কিছু মনে রাখতে পারাকে স্মৃতিশক্তি বলে। কোন ব্যক্তির স্মৃতিশক্তি প্রখর হলে সে কত ধরণের সুবিধা ও কল্যাণ লাভ করে, এর কোন শেষ নেই।
![]() |
পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়ার দোয়া |
মহান আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে স্মৃতিশক্তি বাড়াতে দোয়া, জিকির বেশ কিছু কাজের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। জ্ঞান বৃদ্ধির অনেক দোয়া ও আমল কোরআন-হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।
এসব আমল করলে ও দোয়া পড়লে, আল্লাহ তাআলা জ্ঞান বৃদ্ধি করে দেন। কল্যাণকর জ্ঞান ও ইলম দান করেন। তাই আমরা প্রত্যেক মুসলিমের উচিত বেশি বেশি করে এসব দোয়া পড়া ও আমল করা।
এখানে একটি খুবই চমৎকার দোয়া উল্লেখ করা হল। যেটি পড়লে আল্লাহ তাআলা স্মরণশক্তি বৃদ্ধি করে দেন। যেমনঃ
দোয়াটি হল (আরবি)
ﺳُﺒْﺤَﺎﻧَﻚَ ﻻَ ﻋِﻠْﻢَ ﻟَﻨَﺎ ﺇِﻻَّ ﻣَﺎ ﻋَﻠَّﻤْﺘَﻨَﺎ ﺇِﻧَّﻚَ ﺃَﻧﺖَ ﺍﻟْﻌَﻠِﻴﻢُ ﺍﻟْﺤَﻜِﻴﻢُবাংলা উচ্চারণ
সুবহানাকা লা ইলমা লানা ইল্লা মা আল্লামতানা, ইন্নাকা আনতাল আলিমুল হাকিম।অর্থঃ (হে আল্লাহ) আপনি পবিত্র! আমরা কোন কিছুই জানি না, তবে আপনি আমাদিগকে যা শিখিয়েছ (সেগুলো ব্যতীত) নিশ্চয় আপনিই প্রকৃত জ্ঞানসম্পন্ন, হেকমতওয়ালা। (২/৩২)।
কোরআন সুন্নাহর আলোকে এখানে কয়েকটি দোয়া ও আমল বলা হয়েছেঃ
১. ইখলাস বা আন্তরিকতা
যেকোন কাজে সফলতা অর্জনের ভিত্তি হল ইখলাস বা আন্তরিকতা। আর ইখলাসের মূল উপাদান হচ্ছে বিশুদ্ধ নিয়ত।নিয়তের বিশুদ্ধতার গুরুত্ব সম্পর্কে উস্তাদ খুররাম মুরাদ বলেন, উদ্দেশ্য বা নিয়ত হল আমাদের আত্মার মতো অথবা বীজের ভিতরে থাকা প্রাণশক্তির মতো।
বেশিরভাগ বীজই দেখতে মোটামুটি একইরকম, কিন্তু লাগানোর পর বীজগুলো যখন চারাগাছ হয়ে বেড়ে উঠে আর ফল দেওয়া শুরু করে তখন আসল পার্থক্যটা পরিস্কার হয়ে যায় আমাদের কাছে।
একইভাবে নিয়ত যত বিশুদ্ধ হবে আমাদের কাজের ফলও তত ভাল হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
তাদের এছাড়া কোন নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর এবাদত করবে, নামাজ কায়েম করবে এবং জাকাত দেবে। এটাই সঠিক ধর্ম।’ (সুরা আল-বায়্যিনাহ, আয়াত : ০৫)
তাই অবশ্যই আমাদের নিয়ত হতে হবে এমন যে, আল্লাহ আমাদের স্মৃতিশক্তি যেন একমাত্র ইসলামের কল্যাণের জন্যই বাড়িয়ে দেন।
২. দোয়া করা ও জিকির করা
আমরা সকলেই জানি আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোন কাজেই সফলতা অর্জন করা সম্ভব নয়। এজন্য আমাদের উচিত সর্বদা আল্লাহর কাছে দোয়া করা।যাতে তিনি আমাদের স্মৃতিশক্তি বাড়িয়ে দেন এবং কল্যাণকর জ্ঞান দান করেন। এক্ষেত্রে আমরা নিন্মোক্ত দুআটি পাঠ করতে পারি।
رَّبِّ زِدْنِي عِلْمًا
বাংলা উচ্চারণঃ
রাব্বি যিদনি ইলমাঅর্থঃ
হে আমার প্রতিপালক! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করুন। (সুরা ত্বাহা, আয়াতঃ ১১৪)তাছাড়া জিকির বা আল্লাহর স্মরণও স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, যখন ভুলে যান, তখন আপনার পালনকর্তাকে স্মরণ করুন...। (সুরা কাহাফ, আয়াতঃ ২৪)।
তাই আমাদের উচিত জিকির, তাসবিহ (সুবহান আল্লাহ), তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ), তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) ও তাকবির (আল্লাহু আকবার) এর মাধ্যমে প্রতিনিয়ত আল্লাহকে স্মরণ করা।
৩. পাপ থেকে দূরে থাকা
প্রতিনিয়ত পাপ করে যাওয়ার একটি প্রভাব হচ্ছে দুর্বল স্মৃতিশক্তি। পাপের অন্ধকার ও জ্ঞানের আলো কখনো একসাথে থাকতে পারে না।ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, আমি (আমার শাইখ) ওয়াকিকে আমার খারাপ স্মৃতিশক্তির ব্যাপারে অভিযোগ করেছিলাম এবং তিনি শিখিয়েছিলেন আমি যেন পাপকাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখি।
তিনি বলেন, আল্লাহর জ্ঞান হল একটি আলো এবং আল্লাহর আলো কোন পাপচারীকে দান করা হয় না। ইয়াহইয়া বিন ইয়াহইয়া বলেন, এক ব্যক্তি মালিক ইবনে আনাসকে প্রশ্ন করেছিলেনঃ
হে আবদ-আল্লাহ, আমার স্মৃতিশক্তিকে শক্তিশালী করে দিতে পারে এমন কোন কিছু কি আছে? তিনি বলেন, যদি কোন কিছু স্মৃতিকে শক্তিশালী করতে পারে তা হল পাপ করা ছেড়ে দেয়া। (আল-জামি : ২/৩৮৭)।
যখন কোন মানুষ পাপ করে এটা তাকে উদ্বেগ ও দুঃখের দিকে ধাবিত করে। সে তার কৃতকর্মের ব্যাপারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে তার অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যায়।
এবং জ্ঞান অর্জনের মতো কল্যাণকর ‘আমল থেকে সে দূরে সরে পড়ে। তাই আমাদের সকলের উচিত পাপ থেকে দূরে থাকার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা।
৪. বিভিন্ন উপায়ে চেষ্টা করা
একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে আমরা দেখবো যে, আমাদের সকলের মুখস্থ করার পদ্ধতি বা ধরণ এক নয়। কারও শুয়ে পড়লে তাড়াতাড়ি মুখস্থ হয়, কারও আবার হেঁটে হেঁটে পড়লে তাড়াতাড়ি মুখস্থ হয়।কেউ নীরবে পড়তে ভালবাসে, কেউবা আবার আওয়াজ করে পড়ে। কারো ক্ষেত্রে ভোরে তাড়াতাড়ি মুখস্থ হয়, কেউবা আবার গভীর রাতে ভাল মুখস্থ করতে পারে।
তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজ নিজ উপযুক্ত সময় ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ঠিক করে। তার যথাযথ ব্যবহার করা। আর কুর’আন মুখস্থ করার সময় একটি নির্দিষ্ট মুসহাফ (কোরআনের আরবি কপি) ব্যবহার করা।
কারণ বিভিন্ন ধরণের মুসহাফে পৃষ্ঠা ও আয়াতের বিন্যাস বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। একটি নির্দিষ্ট মুসহাফ নিয়মিত ব্যবহারের ফলে মস্তিষ্কের মধ্যে তার একটি ছাপ পড়ে যায় এবং মুখস্থকৃত অংশটি অন্তরে গভীরভাবে গেঁথে যায়।
৫. মুখস্থকৃত বিষয়ের উপর আমল করা
আমরা সকলেই এ ব্যাপারে একমত যে, কোন একটি বিষয় যতো বেশিবার পড়া হয় তা আমাদের মস্তিষ্কে ততো দৃঢ়ভাবে জমা হয়। কিন্তু আমাদের এই ব্যস্ত জীবনে অতো বেশি পড়ার সময় হয়তো অনেকেরই নেই।তবে চাইলেই কিন্তু আমরা এক ঢিলে দুই পাখি মারতে পারি। আমরা আমাদের মুখস্থকৃত সূরা কিংবা সূরার অংশ বিশেষ সুন্নাহ ও নফল সালাতে তিলাওয়াত করতে পারি।
এবং দোয়াগুলো পাঠ করতে পারি সালাতের পর কিংবা অন্য যেকোন সময়। এতে একদিকে আমল করা হবে আর অন্যদিকে হবে মুখস্থকৃত বিষয়টির ঝালাইয়ের কাজ।
৬. অন্যকে শেখানো
কোন কিছু শেখার একটি উত্তম উপায় হল তা অন্যকে শেখানো। আর এজন্য আমাদেরকে একই বিষয় বারবার ও বিভিন্ন উৎস থেকে পড়তে হয়। এতে করে ওই বিষয়টি আমাদের স্মৃতিতে স্থায়ীভাবে গেঁথে যায়।৭. মস্তিষ্কের জন্য উপকারী খাদ্য গ্রহণ
পরিমিত ও সুষম খাদ্য গ্রহণ মানুষের মস্তিষ্কের সুস্বাস্থ্যের জন্য একান্ত আবশ্যক। অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ মানুষের ঘুম বাড়িয়ে দেয়, যা আমাদের অনেকটা অলস করে তোলে। ফলে আমরা জ্ঞানার্জন থেকে বিমুখ হয়ে পড়ি।এছাড়াও কিছু কিছু খাবার রয়েছে যেগুলো আমাদের মস্তিষ্কের জন্য খুবই উপকারী। সম্প্রতি সময়ে ফ্রান্সের এক গবেষণাগারে গবেষণা করে দেখা গিয়েছে যে, যয়তুনের তেল চাক্ষুস স্মৃতি এবং বাচনিক সাবলীলতা বৃদ্ধি করে থাকে।
এছাড়াও যেসব খাদ্যে অধিক পরিমাণে Omega-3 ফ্যাট রয়েছে। সেসব খাদ্য স্মৃতিশক্তি ও মস্তিষ্কের কার্যকলাপের জন্য খুবই উপকারী হয়ে থাকে।
স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধির জন্য অনেক আলিম কিছু নির্দিষ্ট খাদ্য গ্রহণের কথা বলেছেন। আপনারা চাইলে সেসব খাবার গুলোও খেতে পারেন। ইমাম আয-যুহরি বলেন, তোমাদের মধু পান করা উচিত কারণ এটি স্মৃতির জন্য উপকারী।
মধুতে রয়েছে মুক্ত চিনিকোষ যা আমাদের মস্তিষ্কের গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এছাড়া মধু পান করার সাত মিনিটের মধ্যেই রক্তে মিশে গিয়ে কাজ শুরু করে দেয়। তিনি আরও বলেন, যে ব্যক্তি হাদীস মুখস্থ করতে চায়, তার উচিত কিসমিস খাওয়া।
৮. পরিমিত পরিমাণে বিশ্রাম নেওয়া
আমরা যখন ঘুমাই তখন আমাদের মস্তিষ্ক অনেকটা ব্যস্ত অফিসের মতো কাজ করে। এটি তখন সারাদিনের সংগৃহীত তথ্যসমূহ প্রক্রিয়াজাত করে।তাছাড়া ঘুম মস্তিষ্ক কোষের পুণর্গঠন ও ক্লান্তি দূর করার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে দুপুরে সামান্য ভাতঘুম আমাদের মন-মেজাজ ও অনুভূতিকে চাঙা রাখে। এটি একটি সুন্নাহও বটে।
আর অতিরিক্ত ঘুমের কুফল সম্পর্কে তো আগেই বলা হয়েছে। তাই আমাদের সকলে উচিত গভীর রাত পযন্ত না জেগে মস্তিষ্ককে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দেওয়া।
৯. জীবনের অপ্রয়োজনীয় ব্যাপারগুলো ত্যাগ করা
বর্তমানে আমাদের মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা কমে যাওয়া ও জ্ঞান অর্জনে অনীহার একটি অন্যতম কারণ হল আমরা নিজেদের বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় কাজে জড়িয়ে রাখি।ফলে কোন কাজই আমরা গভীর মনোযোগের সাথে করতে পারি না। মাঝে মাঝে আমাদের কারও কারও অবস্থা তো এমন হয় যে, সালাতের কিছু অংশ আদায় করার পর মনে করতে পারি না। ঠিক কতোটুকু সালাত আমরা আদায় করেছি।
আর এমনটি হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে আড্ডাবাজি, গান-বাজনা শোনা, বিভিন্ন মুভি দেখা, ফেইসবুকিং ইত্যাদি নানান অপ্রয়োজনীয় কাজে জড়িয়ে রাখা। তাই আমাদের উচিত এগুলো থেকে যতোটা সম্ভব দূরে থাকা।
১০. হাল না ছাড়া
যেকোন কাজে সফলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হচ্ছে হাল না ছাড়া। যে কোন কিছু মুখস্থ করার ক্ষেত্রে শুরুটা কিছুটা কষ্টসাধ্য হয়ে থাকে।কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আমাদের মস্তিষ্ক সবকিছুর সাথে মানিয়ে নেয়। তাই আমাদের উচিত শুরুতেই ব্যর্থ হয়ে হাল না ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।