ইতেকাফ ভঙ্গের কয়েকটি কারণ | ইতেকাফের ফজিলত

পবিত্র রমজান মাসের প্রতিটি ক্ষণই মুসলিম উম্মাহর জন্য মহামূল্যবান। পরকালীন চূড়ান্ত সাফল্যের জন্য মুমিনরা এই মাসে বেশি বেশি আমল করে থাকে। প্রথম দশ দিনে মহান আল্লাহর রহমতে বান্দা নিজেকে পবিত্রতায় সিক্ত করে নেয়। 

রমজান
রমজান

দ্বিতীয় দশ দিনে ক্ষমা লাভের মাধ্যমে বান্দা নিজেকে মহান আল্লাহর কাছে পৌঁছতে সক্ষম হয়। এবং শেষ দশ দিনে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার নিশ্চয়তা লাভের চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করে।

এজন্য মহান আল্লাহ ও তার রাসুল রমজানের শেষ দশকের প্রতি অসাধারণ গুরুত্বারোপ করেছেন। পাশাপাশি নানান নফল ইবাদতের দ্বারা শেষ দশককে সমৃদ্ধ করেছেন।

রমজানের শেষ দশ দিনের মর্যাদা

পবিত্র রমজান মাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হচ্ছর শেষ দশ দিন। কারণ, আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এই সময়কে অনেক গুরুত্ব দিতেন। এই সময়ে তাঁর আমল বর্ণনা করতে গিয়ে আয়েশা (রা.) বলেন প্রিয় নবী (সা.) রমজানের শেষ দশকে (ইবাদত-বন্দেগিতে) যে পরিশ্রম করতেন তা অন্য কোনও সময় করতেন না। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১১৭৫ তিরমিজি, হাদিস : ৭৯৬)।

প্রিয় নবীর (সা.) পরিবারের সদস্য ও প্রিয় জামাতা আলি ইবনে আবি তালিব (রা) বলেন, রমজানের শেষ দশকে প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) (ইবাদত-বন্দেগি করার নিমিত্ত) তার পরিবারদের (রাতে) জাগিয়ে দিতেন। (তিরমিজি, হাদিস ৭৯৫, মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৭৬২)।

আয়েশা (রা.) আরও বলেন, প্রিয় নবী (সা.) যখন রমজানের শেষ দশকে প্রবেশ করতেন, তখন রাতে জেগে থাকতেন, পোশাক পরিধেয় বেঁধে নিতেন এবং পরিবারের সদস্যদের (ইবাদত-বন্দেগি করার জন্য) জাগিয়ে রাখতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস ২০২৪, মুসলিম, হাদিস ১১৭৪)।

আমাদেরকেও রমজানের শেষ দশকে ইবাদতে নিমগ্ন হওয়া চাই। বিশেষ করে শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে। কারণ এ রাতগুলোতেই রয়েছে কুরআন নাজিলের মতো মহা-অর্জনসমৃদ্ধ হাজার বছরের চেয়ে সেরা রজনি লাইলাতুল কদর। যেটি রমজানের শেষ দশকের অন্যতম ইবাদত হচ্ছে ইতেকাফ।

ইতেকাফের পরিচয়?

ইতেকাফ শব্দের অর্থ হচ্ছে স্থির থাকা, আবদ্ধ থাকা এবং অবস্থান করা। শরিয়তের পরিভাষায় মাহে রমজানের শেষ দশ দিন অথবা যেকোনও দিন দুনিয়াবি সব কাজকর্ম তথা পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মসজিদে অথবা ঘরের পবিত্র স্থানে ইবাদতের নিয়তে অবস্থান করাকে ইতেকাফ বলে। 

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, মসজিদে ইতেকাফ করা অবস্থায় তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে মিলিত হবে না। (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৭)। পুরুষরা শুধুমাত্র মসজিদেই ইতেকাফ করতে পারবে। সর্বোত্তম স্থান হচ্ছে মসজিদে হারাম, অতঃপর মসজিদে নববি। 

এরপর হচ্ছে মসজিদে আকসা। অতঃপর যেকোন জামে মসজিদ। যে মসজিদে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হয়, সেই মসজিদে ইতেকাফ করা যায়। তবে মনে রাখবেন জামে মসজিদ উত্তম। কারণ তখন জুমা নামাজের জন্য অন্যত্র যেতে হবে না। (ফাতওয়ায়ে শামি ২/১২৯)।

মহিলা অর্থাৎ মা বোনদের জন্য ইতেকাফ করা মুস্তাহাব। তাদের ইতেকাফের স্থান হচ্ছে গৃহকোণের নামাজের স্থান। স্ত্রীর ইতেকাফের জন্য স্বামীর অনুমতি অবশ্যই জরুরি। ইতেকাফ অবস্থায় ওজু, এস্তেঞ্জা এবং পানাহার ইত্যাদি একান্ত প্রয়োজন ছাড়া মসজিদ থেকে বের হওয়া যাবে না। 

অবশ্য মসজিদে অবস্থানকালে ঘুম, বসে থাকা এবং কথাবার্তা বলা যায়। তবে ইতেকাফ অবস্থায় যথাসম্ভব সকল প্রকার জাগতিক চিন্তা ভাবনা। এবং কথাবার্তা ও মেলামেশা বাদ দিয়ে সাধ্যমতো মহান আল্লাহর জিকির ও ইবাদত বন্দেগিতে নিয়োজিত থাকার চেষ্টা করতে হবে। না হলে অন্তত নীরব থাকার চেষ্টা করতে হবে।

ইতেকাফ কত প্রকার ও কি কি?

ইতেকাফ তিন প্রকারঃ

১. সুন্নত ইতেকাফ

রমজান মাসের শেষ দশ দিনের ইতেকাফকে মূলত সুন্নত ইতেকাফ বলে। ২১ তারিখ রাত থেকে শুরু করে ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা পর্যন্ত এই ইতেকাফের সময়। অবশ্য এই ইতেকাফ ভেঙে গেলে পরে আবার এর কাজা করা ওয়াজিব।

২. ওয়াজিব ইতেকাফ

মানতের ইতেকাফ অথবা সুন্নত ইতেকাফের কাজা ইতেকাফ ওয়াজিব।

৩. নফল ইতেকাফ

এই ইতেকাফ মূলত যেকোনও সময় করা যায়। অর্থাৎ এটি হচ্ছে কিছু সময়ের জন্য ইতেকাফের নিয়তে মসজিদে অবস্থান করা। যেকোনও ওয়াক্তে মসজিদে প্রবেশ করার সময় নফল ইতেকাফের নিয়ত করা হচ্ছে সুন্নত।

ইতেকাফের উদ্দেশ্য?

মূলত দুনিয়াদারির ঝামেলা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে। এরপর একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হওয়া এবং বিনয় ও নম্রতায় নিজেকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করা। বিশেষ করে লাইলাতুল কদরে ইবাদত করার সুযোগ লাভ করাই ইতেকাফের অন্যতম উদ্দেশ্য।

ইতেকাফের শর্ত?

১. নিয়ত করা ২. জামাত অনুষ্ঠিত হয় এমন মসজিদে ইতেকাফ করা। ৩. ইতেকাফকারীর রোজাদার হওয়া। ৪ পুরুষ লোকের জামে মসজিদে ইতেকাফ করা ৫. সর্বদা হদসে আকবার থেকে পাক-পবিত্র থাকা।

ইতেকাফের গুরুত্ব?

ইতেকাফ একটি এমন গুরুত্বপূর্ণ আমল যে, প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (স.) হজরত উমর (রা.) জাহেলি যুগের মানতকৃত ইতেকাফ ইসলাম গ্রহণের পর পূরণ করতে বলেছিলেন। নবিজি নিজেও ইতেকাফের আমল করতেন। 

এ প্রসঙ্গে হজরত আয়েশার (রা.) বর্ণনায় এসেছে, প্রিয় নবী (সা.) ইন্তেকাল পর্যন্ত প্রতিবছরই রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করেছেন। তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর সহধর্মিণীরাও ইতেকাফ পালন করতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০২৬; মুসলিম, হাদিস : ১১৭২)।

ইতেকাফের ফজিলত?

ইতেকাফের বিরাট ফজিলতের কথা ঘোষিত হয়েছে হাদিসে নববিতে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, যদি কেউ তার ভাইয়ের প্রয়োজন মেটাতে রওয়ানা হয়, তাহলে এটা তার জন্য দশ বছর ইতেকাফ করার চেয়েও উত্তম। 

আর যে ব্যক্তি একদিন আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইতেকাফ করবে আল্লাহ তার ও জাহান্নামের মধ্যে তিনটি পরিখার দূরত্ব সৃষ্টি করবেন, প্রত্যেক পরিখার প্রশস্ততা দুই দিগন্তের চেয়েও বেশি। (শুআবুল ইমান লিল-বায়হাকি, হাদিস ৩৬৭৯)।

ইতেকাফের বিশেষ লাভ?

ইতেকাফ হচ্ছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। মোটকথা পবিত্র রমজান মাসে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি বড় মাধ্যম হচ্ছে ইতেকাফ। এর পাশাপাশি লাইলাতুল কদরের ফজিলত লাভের জন্যও এ সময়ে ইতেকাফের গুরুত্ব অনেক বেশি। 

অর্থাৎ লাইলাতুল কদরপ্রাপ্তি, গুনাহ থেকে পরিত্রাণ, বাকি এগারো মাসের ইবাদতের যথার্থ অনুশীলনসহ অসংখ্য বরকতপূর্ণ আমল করা হয় রমজানের শেষ দশকের ইতেকাফের মাধ্যমে। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, আমি লাইলাতুল কদরের মহিমা অনুসন্ধানে প্রথম দশদিন ইতেকাফ করেছি। 

অতঃপর এবং মাঝের দশদিন ইতেকাফ করেছি, অবশেষে আমার কাছে একজন ফেরেশতা এসে বলেন, তা শেষ দশকে। কাজেই তোমাদের মধ্যে যারা ইতেকাফ করতে চায়, তারা যেন শেষ দশকে ইতেকাফ করে। অতঃপর সাহাবায়ে কেরাম তাঁর সঙ্গে শেষ দশকে ইতেকাফ করলেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১১৬৭)।

আমরা তাহলে বুঝতে পারলাম যে, উপরিউক্ত আলোচনা দ্বারা একমাত্র ইতেকাফের মাধ্যমেই পবিত্র রমজানের শেষ দশ দিনের পূর্ণ সাওয়াব এবং সৌভাগ্য লাভ করে ধন্য হওয়া যায়। মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে যথাযথভাবে ইতেকাফ করে বরকত ও কল্যাণ লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন।
Next Post Previous Post