দুর্নীতির কারণ ও প্রতিকার
দুর্নীতি হচ্ছে একটি সামাজিক ব্যাধি। মূলত এটি সংঘটিত হওয়ার পেছনে সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ বিদ্যমান। নিম্নে আলোচনার সুবিধার্থে দুর্নীতি বৃদ্ধির কিছু কারণ ও প্রতিকার ধাপ আকারে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।
![]() |
দুর্নীতি |
আপনারা যদি সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি মনযোগ সহকারে পড়েন। তাহলে পুরো বিষয়টি বুঝতে পারবেন।
ইসলামের সঠিক শিক্ষা গ্রহণকারীর অভাব
দুর্নীতি বিস্তারের অন্যতম কারণ হচ্ছে যথোপযুক্ত ধর্মীয় শিক্ষার অভাব থাকা। ধর্মীয় শিক্ষা মানুষকে সৎ, যোগ্য, আদর্শবান এবং নীতিবান হতে শেখায়। একই সঙ্গে ঘুষ ও দুর্নীতির ভয়াবহতা সম্পর্কে জ্ঞান দান করে। তাই ধর্মপ্রাণ মানুষেরা এ সকল অন্যায় ও অপকর্ম থেকে বিরত থাকে।পক্ষান্তরে ধর্মহীন শিক্ষা মানুষকে ভোগবাদী, স্বার্থবাদী ও স্বেচ্ছাচারী হতে প্ররোচিত করে এবং পরকালীন জবাবদিহিতা থেকে উদাসীন হতে শেখায়। আর তাই তারা দুর্নীতি করতে এত টুকুও পরোয়া করে না।
অধিক পাওয়ার আশা
আমরা মানবজাতির স্বভাবই এমন যে, যে যত পায় সে তত চায়। কেউ কেউ এমন যে একটা গাড়ি পেলে দশটা চায়, এভাবে সারাজীবন পেতে থাকলেও তার মন ভরে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যদি কোন আদম সন্তান একটি স্বর্ণের উপত্যকার মালিক হয়ে যায়।তাহলে সে এরূপ আরও একটি পেতে আকাঙ্ক্ষা করে। মাটি ছাড়া আর কিছুই তার পেট ভরাতে পারে না। আর যে ব্যক্তি তাওবাহ করে, আল্লাহ তায়ালা তার তাওবাহ কবুল করেন।(মুসলিম, হাদিস নং-২৩০৭)।
যোগ্য ব্যক্তিকে দায়িত্ব না দেওয়া
দুর্নীতির অন্যতম কারণ হল ঘুষ, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবে অদক্ষ, অনভিজ্ঞ এবং অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দান। অথচ প্রশাসনকে দুর্নীতির করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করার জন্য ইসলামের স্পষ্ট নির্দেশ হচ্ছে সৎ, যোগ্য ও দক্ষ লোককে নিয়োগ করা।এই বিষয়ে খোলাশা করতে কোরআন মাজিদে হজরত মুসা (আ.) এর কর্মী হিসেবে মনোনয়নের ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, অতঃপর মেয়ে দুটির একজন বলল, হে পিতা! একে কর্মচারী নিযুক্ত করুন!
নিশ্চয়ই আপনার কর্মসহায়ক হিসাবে সেই উত্তম হবে, যে শক্তিশালী এবং বিশ্বস্ত। (সুরা ক্বাছাছ, আয়াত-২৬) এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা আমানতসমূহকে তার যথার্থ হকদারগণের নিকটে পৌঁছে দাও।’(সুরা নিসা, আয়াত-৫৮)।
হালাল হারামের তোয়াক্কা না করা
দুর্নীতির আরও একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে হালাল-হারামের তোয়াক্কা না করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা। অথচ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, হারাম খাদ্যে গঠিত দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (বায়হাক্বী, শুআবুল ঈমান হাদিস সং-১১৫৯; সহিহ হাদিস নং-২৬০৯; মিশকাত হাদিস নং-২৭৮৭)।জবাবদিহিতার অনুভূতির অভাব
দুর্নীতির প্রধান ও মুখ্য কারণ হচ্ছে জবাবদিহিতার অনুভূতি। জবাবদিহিতা প্রধানত দুই প্রকার। যেমনঃ
- ইহকালীন জবাবদিহিতা
- পরকালীন জবাবদিহিতা
বিভিন্ন কৌশলে ইহকালীন জবাবদিহিতা থেকে রক্ষা পেলেও পরকালীন অথাৎ আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতা থেকে কোনভাবেই রক্ষা পাওয়া যাবে না। মূলত ইহকালীন অসৎ কর্মকাণ্ডের বিষয়েই পরকালে জবাবদিহি করতে হবে প্রতিটি ব্যক্তিকে।
এই অনুভূতি কারো মাঝে জাগ্রত থাকলে সে কখনো ঘুষ লেনদেন এবং অন্যান্য দুর্নীতি করতে পারে না। মহান আল্লাহ পরকালীন জবাবদিহিতার বিষয়ে সতর্ক করে বলেন, নিশ্চয়ই তোমার পালনকর্তার পাকড়াও অত্যন্ত কঠিন। (সুরা বুরূজ, আয়াত-১২)।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাব
দুর্নীতি সৃষ্টির অন্যতম কারণ হচ্ছে বিচারব্যবস্থার পূর্ণ স্বাধীনতা খর্ব করা। বিচার বিভাগকে প্রভাবমুক্ত রাখতে না পারলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা একেবারেই অসম্ভব। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘মাখজুম গোত্রের এক নারী চোরের ঘটনা কোরাইশের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন করে তুলল।এ অবস্থায় তারা বলাবলি করতে লাগল যে, এ ব্যাপারে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে কে আলাপ করতে পারে? তারা বলল, একমাত্র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয়তম উসামা বিন জায়েদ (রা.) এ ব্যাপারে আলোচনা করার সাহস করতে পারেন।
উসামা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে কথা বলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তুমি কি আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘনকারিণীর সাজা মওকুফের সুপারিশ করছ?
অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁড়িয়ে খুতবায় বলেন, তোমাদের আগের জাতিগুলোকে এ কাজই ধ্বংস করেছে যে, যখন তাদের মধ্যে কোন বিশিষ্ট লোক চুরি করত, তখন তারা বিনা সাজায় তাকে ছেড়ে দিত।
অন্যদিকে যখন কোন অসহায় গরিব সাধারণ লোক চুরি করত, তখন তার ওপর হদ জারি করত। আল্লাহর কসম! যদি মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কন্যা ফাতেমা চুরি করত তাহলে আমি অবশ্যই তার হাত কেটে দিতাম।’(বুখারি, হাদিস নং-৩৪৭৫)।
দুর্নীতি প্রতিরোধে করণীয়?
কর্মী নিয়গে সচেতনতা
বর্তমানে কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে যদি সরকারি নজরদারি একটু বাড়িয়ে সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেওয়া যায়। তবেই বাংলাদেশ জিরো টলারেন্স নীতি কার্যকর করতে পারবে।এবং আমলাতন্ত্রের জটিলতা কিংবা লাল ফিতার দৌরাত্ম্য কমে যাবে। নিয়োগকারীর সততাই মূলত দুর্নীতি প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখবে।
ইসলামী শিক্ষার বিস্তার
ঘুষ এবং দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের আবশ্যিক পূর্বশর্ত হল ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করা। মক্তবভিত্তিক শিক্ষাকে পুনরায় বেগবান করা, যাতে একটা শিশু স্কুলে পা দেওয়ার আগেই ন্যায়নিষ্ঠার শিক্ষা অবশ্যই পায়। প্রত্যেক পরিবারের উচিৎ সপ্তাহে অন্তত একটা দিন নির্দিষ্ট করে রাখা।যেই দিন সন্তানদের নিয়ে ভাল মন্দ বিষয়ে আলোচনা করতে পারেন। কারণ পারিবারিক শিক্ষাই মূলত একজন মানুষের সুশিক্ষার ভিত্তি।
অল্পতেই সন্তুষ্ট থাকা
আমাদের উচিৎ সর্বদা অল্পতেই সন্তুষ্ট থাকার অভ্যাস গড়ে তোলা। অতিরিক্ত পাওয়ার আশা একপর্যায়ে এসে একজন মানুষকে জাহান্নামের পথ যাত্রী বানিয়ে দেয়। তাই যখনই আমাদের অতিরিক্ত পাওয়ার নেশা মনে ধরবে তখনই ইস্তিগফার পাঠ করা উচিৎ এবং নিজের থেকে নিম্নস্তরের মানুষের অবস্থা থেকে শুকরিয়া আদায় করা।সমাজের বর্তমান অবস্থা দেখলে এটা স্পষ্ট ভাবেই প্রতীয়মান হয় যে, অতিরিক্ত পাওয়ার আশায় একজন ব্যক্তি সরাসরি দুর্নীতিকে আপন করে নেয়। পরিবারের অতিরিক্ত চাওয়া মেটানোর জন্য খারাপ কাজ করতে বাধ্য হয়ে থাকে তারা। তাই অবশ্যই একটি পরিবারের উচিৎ এই ক্ষেত্রে অধিক সতর্ক থাকা।
হালাল হারাম মেনে চলা
এমন সম্পদের পাহাড় তৈরির কি দরকার আছে, যা আমাদের জান্নাতে প্রবেশ করতে দেবে না। এই দুনিয়ার সুখের আশায় দুর্নীতি করেও তো শান্তি নেই। আখিরাতেও আছে কঠোর শাস্তির সেই জাহান্নাম। আবার হারামের মাঝে ডুবে থাকলে দোয়াও কবুল হয় না।হাদিসে এসেছে, অতঃপর তিনি এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন। যে দীর্ঘ সফর করছে। যার চুল উষ্কখুষ্ক, কাপড় ধূলিমলিন। সে আকাশ পানে দুহাত প্রসারিত করে বলে, হে আমার প্রতিপালক! হে আমার প্রতিপালক!
অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পরিধেয় বস্ত্র হারাম এবং হারাম দ্বারা দেহ গঠিত। কাজেই এমন ব্যক্তির দোয়া কিভাবে কবুল হতে পারে? (মুসলিম হাদিস নং-১০১৫; সহিহ তিরমিযি হাদিস নং-২৯৮৯; সহিহুল জামে হাদিস নং-২৭৪৪) উল্লেখিত হাদিস মেনে চললে ঘুষ ও দুর্নীতি বিদূরিত হবে, এতে কোন সন্দেহ নেই।
জবাবদিহিতাকে ভয় করা
মানুষ তার দুর্নীতিকে দুনিয়ার মানুষের নিকট থেকে লুকাতে পারলেও আল্লাহর নিকট থেকে কিছুতেই কখন লুকাতে পারবে না। মহান আল্লাহ বলেন, তিনি জানেন তোমাদের চোখের চুরি ও অন্তরের লুকানো বিষয়সমূহ। (সুরা মুমিন, আয়াত-১৯)।অন্যত্র তিনি বলেন, অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা সে দেখতে পাবে। আর কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও সে দেখতে পাবে।(সুরা যিলযাল, আয়াত-৭, ৮)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল।
কাজেই প্রত্যেকেই নিজ অধীনদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। শাসক জনগণের দায়িত্বশীল, তিনি তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবেন। একজন পুরুষ তার পরিবার-পরিজনের দায়িত্বশীল, সে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। স্ত্রী স্বামীর ঘরের এবং তার সন্তানের দায়িত্বশীল, সে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে।
আর কৃতদাস আপন মনিবের সম্পদের দায়িত্বশীল, কাজেই সে বিষয়ে সে জিজ্ঞাসিত হবে। সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পাদনে জিজ্ঞাসিত হবে। (বুখারি, হাদিস নং-২৫৫৪, ২৫৫৮; মুসলিম, হাদিস নং-১৮২৯)।
হাশরের মাঠে আদম সন্তান আল্লাহতায়ালার পাঁচটি প্রশ্নের জবাব না দিয়ে এক পাও সামনে এগুতে পারবে না। তার মধ্যে একটি প্রশ্ন হচ্ছে সে তার সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে যে, সে কিভাবে তা অর্জন করেছে এবং কোন পথে তা ব্যয় করেছে।’ (তিরমিযি, হাদিস নং-২৪১৭; সহিহুল জামে, হাদিস নং-৭২৯৯ সনদ সহিহ)।
অতএব দুনিয়া এবং আখিরাতের উভয় স্থানের জবাবদিহি হওয়ার কথা মাথায় রেখে আমাদের কাজ করে যেতে হবে। আইনের ফাঁক-ফোকর এড়িয়ে আমরা দুনিয়ার জবাবদিহিতা থেকে বাঁচতে পারলেও আল্লাহতায়ালার পাকরাও কিন্তু বড়ই কঠিন।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতাদান
একটি দেশের দায়িত্ববান সরকারের উচিৎ বিচার বিভাগকে অবশ্যই সম্পূর্ণরূপে অন্য বিভাগ থেকে বিশেষ করে শাসন বিভাগের কতৃত্ব থেকে নিরপেক্ষ রাখা। বিচার বিভাগের স্বাধীনতাই মূলত একটি দেশের দুর্নীতিমুক্ত থাকার সর্বোত্তম পন্থা।যদি বিচার বিভাগ সুষ্ঠুভাবে বিচারকার্য সম্পূর্ণ করতে না পারে। তাহলে আর দুর্নীতি রোধের চিন্তা স্বপ্নই থেকে যাবে বাস্তবায়ন কখনো হবে না। প্রতিটি স্বাধীন দেশের জন্য স্বাধীন বিচার বিভাগ একদম অপরিহার্য।
মহান আল্লাহ তায়ালা, দুর্নীতি সম্পর্কে সচেতন থাকার ও তাঁর মনোনীত একমাত্র দীন ইসলামের প্রতিটি আদেশ নিজেদের জীবনে বাস্তবায়িত করার তৌফিক দান করুন। আমিন।